বাংলা গানের ‘প্রিন্স’ আর শুভ্র, কী করছেন আপনারা?

0
51

গায়ক শুভ্রদেবের একুশে পদক পাওয়া নিয়ে যে আলোচনা আর সমালোচনা তা এখন রীতিমত কাদা ছোঁড়াছুড়িতে পরিণত হয়েছে। আর এই কাদা ছোঁড়াছুড়িতে জড়িয়ে গেছেন শিল্পী শুভ্রদেব আর বাংলা গান আর সুরের জগতের সত্যিকারের ‘রাজকুমার’ প্রিন্স মাহমুদ। শুভ্রদেবের একুশে পদকপ্রাপ্তির খবর প্রকাশের পর প্রিন্স মাহমুদ ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। প্রিন্স মাহমুদ তার পোস্টে লেখেন ‘দেশের সংগীতে শুভ্রদেবের অবদান আছে। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি অবদান লাকী আখান্দ্‌, আইয়ুব বাচ্চু, ফুয়াদ নাসের বাবু, নকীব খান, কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী, হামিন আহমেদ, মাকসুদুল হক, মাহফুজ আনাম জেমস এবং প্রিয় গীতিকবি কাওসার আহমেদ চৌধুরী ও শহীদ মাহমুদ জঙ্গির। প্রিয় শুভ্রদেবের উচিত এই প্রসঙ্গে কথা বলা। নিজে পদক না গ্রহণ করে সত্যিকার মেধাবীকে পদক দিতে বলার এই সংস্কৃতি এখনই শুরু হোক…।’

এমন পোস্ট দেওয়ার কারণে শুভ্র দেব রাগ হতে পারেন মনে করেন প্রিন্স মাহমুদ। পরে মন্তব্যের ঘরে প্রিন্স মাহমুদ লিখেছেন, ‘শুভ্রদা আমার কাছের মানুষ আমার ওপর রাগ করবেন কিন্তু সত্য বলছি, এই সত্য যদি স্বীকার করেন, তাহলে শিল্পী হিসেবে তাঁর জায়গা অনেক ওপরে থাকবে…। এখানে শুভ্র দেব নামটি উপলক্ষমাত্র, যিনি পদক পাচ্ছেন, তিনি যদি উপলব্ধি করেন তাঁর চেয়ে যোগ্যতর মানুষটি পদকের ক্ষেত্রে বঞ্চিত, তিনি তাঁর কথা বলে যাবেন। সব ক্ষেত্রেই তা হওয়া উচিত। এই চর্চা থাকলে আরও বহু গুণী মানুষ পেতাম আমরা। যা–ই হোক, সত্যিকার মেধাবীকে পদক দিতে বলার এই সংস্কৃতি আজ থেকেই, এখনই শুরু হোক…।’

সেই পোস্টের পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টা জবাব দেন শুভ্রদেব। সেই জবাবে প্রিন্স মাহমুদ প্রসঙ্গে শুভ্রদেব সরাসরি বলেন, ‘প্রিন্স মাহমুদ ক্যারিয়ারের দিক থেকে আমার অনেক জুনিয়র। ও (প্রিন্স মাহমুদ) আমার পল্লবীর বাসায় এসে বসে থাকত আমাকে দিয়ে গাওয়ানোর জন্য। ও একটা মিক্সড অ্যালবামে গান করার জন্য অনেক দিন গিয়ে বসে ছিল। আমি মিক্সড অ্যালবামে গান করব না। কারণ, তখন সলো অ্যালবামে আমি সবচেয়ে বেশি টাকা নিতাম। তারপরও আমার খারাপ লাগল, অনেক ইয়াং একটা ছেলে।’

শুভ্রদেব আরও লেখেন ‘আজকে যদি সৈয়দ আব্দুল হাদী, রুনা লায়লার মতো শিল্পীরা কিছু বলতেন, তাহলে হয়তো আমি ভাবতাম। জুনিয়ররা অনেকে অনেক কিছু বলে ফেলে, আমি এগুলো ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখি। আমার মনে হয়, তিনি কারও ইন্ধনে এমন কথা বলেছেন। নইলে এমন কথা কীভাবে তিনি বলেন! যাঁরা সমালোচনা করছেন, তাঁরা তো আমার লেভেলের (সমসাময়িক) না। তিনি (প্রিন্স মাহমুদ) তো আমার গানের জন্য বাসায় এসে বসে থাকতেন। কদিন আগেও তিনি আমাকে গানের জন্য ফোন করেছেন।’

গণমাধ্যমেও কথা বলেছেন শুভ্র দেব। তিনি বলেন, ‘আমি ইন্ডাস্ট্রিতে যা দিয়েছি, এমনটা খুব কম শিল্পীর কন্ট্রিবিউশন আছে। শুধু গান গাইলেই হয় না। বাংলা গানের শিল্পী হিসেবে আমি প্রথম আন্তর্জাতিকভাবে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়ে কাজ করেছি। বাংলাদেশ যখন টেস্ট স্ট্যাটাস পায়, তখন বাংলাদেশের শিল্পী হিসেবে প্রথম থিম সং করেছি। শুধু তা-ই নয়, দেশের প্রথম পুরুষ শিল্পী হিসেবে বলিউডের মিউজিক অ্যাওয়ার্ডে আমন্ত্রণ পেয়েছি। এ ছাড়া মাত্র ১২ বছর বয়সে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি। মাদার তেরেসাসহ আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছি। বাংলা গানকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করে তুলতে আমি নিরলস কাজ করেছি। তাই যাঁরা আমার কাজ সম্পর্কে জানেন, তাঁরা বেশির ভাগই আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, এই পদক অনেক আগেই আমার পাওয়া উচিত ছিল।’

শুভ্রদেবের এমন মন্তব্যের পর প্রিন্স মাহমুদ আরেকটি পোস্ট দেন যাতে তিনি বলেন, তিনি শুভ্রদেবের পল্লবীর বাসা চিনতেন না। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘আমি অতি ক্ষুদ্র মানুষ। কিন্তু মিথ্যা বলি না। তিনি সত্য গোপন করছেন। কিছুদিন আগে কেন, আমি তাঁকে ২৫ বছরে ফোন করি নাই।‘

প্রিন্স লেখেন ‘ভদ্রলোকের বাসা যে পল্লবী, এটা জানতাম না। সব সময় আমি সবার থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করি। অতি নিকটজন না হলে আড্ডায় বসি না, কোথাও গিয়ে বসে থাকা তো দূর। পুরোনো দিনে গানের যোগাযোগ সব স্টুডিওতে হতো। কাজ শেষ হলে এক মুহূর্ত স্টুডিওতে আড্ডা দিই নাই…।’

বাংলা গানকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন প্রিন্স মাহমুদ। যখন ক্যাসেটের যুগ ছিল তখন বিজ্ঞাপনে যেই শোনা যেত ‘প্রিন্স মাহমুদের সুরে’ এই কথাটি, তখন শ্রোতারা ওই ক্যাসেটটি কিনতে দ্বিতীয়বার ভাবতেন না, কারা গেয়েছেন, কি গান আছে, কিছু না, প্রিন্স মাহমুদের সুরে এই কথাটিই যথেষ্ট ছিল। গানের বাইরে কখনই কোন বিষয়ে তিনি আলোচনা-সমালোচনায় জড়িত হননি। প্রিন্স মাহমুদ যে বলেছেন, তিনি সবার থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন, কথাটি পরিপূর্ণভাবে সত্য। গানের বাইরে কোন একটা ইস্যুতে এই প্রথম সম্ভবত: তিনি কথা বলেছেন। তিনি যা বলেছেন তাকে উপেক্ষা করার সুযোগ আসলেই নেই। শুভ্রদেবের একুশে পদক পাওয়াটাকে গ্রহণযোগ্য মেনেও প্রশ্ন উঠতে পারে ‘লাকী আখান্দ্‌, আইয়ুব বাচ্চু, ফুয়াদ নাসের বাবু, নকীব খান, কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী, হামিন আহমেদ, মাকসুদুল হক, মাহফুজ আনাম জেমস এবং প্রিয় গীতিকবি কাওসার আহমেদ চৌধুরী ও শহীদ মাহমুদ জঙ্গির’ মত ব্যক্তিদের আগে শুভ্রদেব এই পদক পানই বা কী করে?

এই প্রশ্ন তোলা যায়, কিন্তু এর জবাব তো শুভ্রদেবের কাছে নেই, এর জবাব তার দেয়ার কথাও না। তিনি পদক পেয়েছেন তা গ্রহণ করবেন এটাই স্বাভাবিক, এটাই নিয়ম। যদি নিয়ম বা প্রথার কোন ব্যত্যয় ঘটে তা শুভ্রদেব ঘটাননি। রাষ্ট্রীয় পদক প্রত্যাখ্যান করাটাও তো শোভন হতো না, আর তিনি কতজনের কথা বলে তা প্রত্যাখ্যান করতেন?

গায়ক শুভ্রদেব দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসী। তাই তার গান এখন আর খুব একটা শোনা যায় না। কিন্তু একটা সময় তিনি কি মানুষকে কম আমোদিত করেছেন? দেশের প্রধান দুই খেলা ক্রিকেট আর ফুটবল নিয়ে সম্ভবত: তিনিই একাই এমন দু’টি গান গেয়েছেন যা বলা যায় ফুটবল আর ক্রিকেটের উদ্বোধনী সঙ্গীতে পরিণত হয়েছে।

শুভ্রদেব গায়ক হিসেবে সুপার না হতে পারেন, কিন্তু তিনি ফেলনা কিছু নন, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার মত তো ননই, আর প্রিন্স মাহমুদের ব্যাপারে তো আগেই বলেছি তিনি বাংলা গানের ‘রাজকুমার’। আপনাদের দু’জনের বাকযুদ্ধ, দু’ভদ্রলোকের কথার লড়াইয়ে নেই, এটা ক্ষেত্রবিশেষে সৌন্দর্য্যের হানি ঘটাচ্ছে, আপনাদের যে ভাবমূর্তি তার সাথে মোটেই যায় না আপনাদের এমন বাকযুদ্ধ। তাই আর বাড়াবাড়ি নয়, দয়া করে আপনারা থামুন। গান সৃষ্টি আর গান গাওয়ায় মন দিন, নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করুন, বাংলা গানকে ঋদ্ধ করুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here