বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং ভারতের বাংলাদেশ নীতি

0
40

বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার ৫৩তম বার্ষিকী উদযাপন করতে চলেছে ঠিক তখন প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশিদের চোখে রাজনৈতিক খলনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অথচ, ১৯৭১ সালে এই দেশটিই দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলাদেশের সহযোগী ছিল।

ভারতের প্রতি বাংলাদেশিদের এমন মনোভাবের পেছনে অন্যতম কারণ হলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে দিল্লির ধারাবাহিক হস্তক্ষেপ। যার শুরুটা বিশেষ করে ২০০৮ সালে। সেবছর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশের জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার পেছনে ভারতের ভূমিকা রয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে শুরু হওয়া ভারতীয় পণ্য বয়কট আন্দোলন বাংলাদেশি তরুণ নেটিজেনদের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আধিপত্যবাদী মনোভাবের কারণেই এই আন্দোলন গতি পেতে শুরু করেছে; যা ভারতীয় অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরুপ।

সরকারি হিসাব মতে, ভারত প্রতিবছর বাংলাদেশে ১৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে থাকে। সীমান্ত পথে অনানুষ্ঠানিক পণ্য পরিবহন ধরলে হিসাবের এ অংক হবে অন্তত দ্বিগুণ।

সুতরাং, বাংলাদেশে ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইন পরিস্থিতি এখানে তাদের রাজনৈতিক ও আধিপত্যবাদী মনোভাবের বিষয়ে আত্ম-অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্ট ভারতীয় সংস্থাগুলোকে সাহায্য করতে পারে।

সম্পর্ক হওয়া উচিত ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা হয় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে বৈষম্যের কারণে। তারা আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নির্বাচনী রায়কে অস্বীকার করে। ১৯৭০ সালের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দ্ব্যর্থহীনভাবে জয়লাভ করে। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চে কয়েক সপ্তাহের সংলাপের মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়। এরপরও পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণের ওপর গণহত্যা শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তান।

পশ্চিমের গণহত্যামূলক আক্রমণ পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা যুদ্ধে পরিণত করে। একটি অখণ্ড পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে প্রথমে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং পরে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। সে যুদ্ধে ভারত সহায়তা করে।

দেশের স্বাধীনতার জন্য যে সমর কৌশল ও প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন সেটি তখন আওয়ামী লীগের ছিল না। সে কারণে শেখ মুজিবুর রহমান সেই দিনগুলোতে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের দ্বারা গ্রেপ্তার হওয়াকে শ্রেয় মনে করেছিলেন। আর দলটির বাকি নেতারা প্রতিবেশী দেশ ভারতে পাড়ি জমান। তাদের উদ্দেশ্য ছিল জীবন বাঁচিয়ে দেশের বাইরে থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখা।

তবে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ, রাজনীতি সচেতন বেসামরিক যুবকদের একটি অংশ এবং বাঙালি সামরিক ও আধাসামরিক কর্মকর্তা ও সৈন্যদের একটি অংশ,  যারা কোনো রাজনৈতিক নির্দেশ ছাড়াই পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। যদিও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা যারা সে সময় পালিয়ে ছিলেন এবং ভারতে স্বেচ্ছা-নির্বাসিত ছিলেন তাদের একটি অংশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ভারতের সহায়তার প্রাপ্তিকে সহজ করে দেয়। তারা ১৯৭১ সালের এপ্রিল মসের প্রথম সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানায়।

সে সময়ের ভারতীয় রাজনৈতিক ও সামরিক বলয়, যারা দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলে ভারতের সবচেয়ে কথিত শত্রু পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলার আকাঙ্ক্ষা করেছিল, তারা তাদের লালিত রাজনৈতিক ও কৌশলগত উদ্দেশ্য পূরণে এই সুযোগকে শতাব্দীর সেরা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। তারা বাংলাদেশকে সাহায্য করতে সম্মত হয় এবং তারাই যুদ্ধ করে।

সে সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি প্রবাসী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। সে সময় প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশি উদ্বাস্তুকে তারা আশ্রয় দিয়েছিল। তারা বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি এ যুদ্ধের জন্য আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে সহায়তা করে। অবশেষে ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার পর ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য লড়াই করেছিল। এমনকি বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি তাদের কয়েকশ যোদ্ধাও এ লড়াইয়ে নিহত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

একটি সম্ভাব্য ভালো সম্পর্কের তিক্ত মোড়

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিবেচনায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সত্যিকারের বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত ছিল। ১৯৭১ সালে দেশ দুটি রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ বিবেচেনায় একটি অভিন্ন জায়গায় এসে মিলিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে উভয় দেশই তাদের স্বার্থ পূরণ করে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে সেই স্বার্থ রক্ষার সম্পর্ক টেকেনি। এর পেছনে কারণ হিসেবে ভারতের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলের আধিপত্যবাদী মানসিকতাই দায়ী।

বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনৈতিক ব্লক, যারা দেশের মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করেছিল, তারা যুদ্ধের সময়ই ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এই সম্পর্কের কারণে অসন্তুষ্ট ছিল। কারণ তারা উভয় দিক হতেই সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং অস্ত্র সংগ্রহের জন্য প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। ভারত চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ প্রক্রিয়াকে বাম প্রভাবমুক্ত রাখতে।

প্রাথমিকভাবে বামপন্থীরা ভারতীয় বামদের কাছ থেকে সীমিত সহায়তা নিয়ে যুদ্ধ করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার ভারতীয় সামরিক স্থাপনা নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন। দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধের কৌশল নিয়ে এসব সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট মতভেদ ছিল। এই সকল বিতর্কিত বিষয় এবং গুরুতর অভিযোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে ভারতের অবদানকে কৃতজ্ঞতার চোখে দেখে।

পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের পরপরই, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সদ্য স্বাধীন দেশের প্রশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য কিছু ভারতীয় বেসামরিক কর্মচারীকে বাংলাদেশে পাঠাতে শুরু করলে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানীকে করা হয়। অযোগ্য অজুহাতে ঢাকায় পাকিস্তানি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকুন, পাকিস্তানি আত্মসমর্পণের পর থেকে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে কলকাতা-ভিত্তিক বাংলাদেশের নির্বাসিত সরকারকে ঢাকায় ফিরতে বাধা দেয়, ইত্যাদি। এই ধরনের ভারতীয় প্রচেষ্টা, যেমনটি পরে বোঝা গেছে, লক্ষ লক্ষেরও বেশি বাংলাদেশি, তাও সবচেয়ে রক্ষণশীল অনুমান অনুসারে, তাদের জীবন উৎসর্গ করা সত্ত্বেও, আরও কয়েক মিলিয়ন বাস্তুচ্যুত হয়েছিল এবং আরও কয়েক মিলিয়নেরও বেশি বাংলাদেশিকে ভারতীয় হিসাবে তুলে ধরার লক্ষ্য ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা হয়রানি ও লাঞ্ছিত করা হয় এবং তাদের সম্পত্তি ধ্বংস করা হয় এবং বাকিরা যুদ্ধের বহুমাত্রিক আঘাতের শিকার হয়। তদুপরি, যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে মূলধারার ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ বাংলাদেশ যুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান বিষয় বলে একটি আখ্যান তৈরি করতে শুরু করে, একইভাবে পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক পর্বকে চিত্রিত করে। . পাকিস্তানিরা তাদের পরাজিত হওয়ার লজ্জাকে আড়াল করার জন্য ঐতিহাসিক ঘটনার এই ঐতিহাসিক আখ্যান তৈরি করে, যা তারা অতীতে প্রচার করত, ‘ভীরু বাঙালিদের অ-মার্শাল জাতি’ যেখানে ভারতীয় রাজনৈতিক-বুদ্ধিজীবী শিল্প সংশ্লিষ্টরা নিজেদের প্রশ্রয় দেয়। বাংলাদেশের সাথে মোকাবিলা করার জন্য ইতিহাস বিকৃত করে। কিন্তু বাংলাদেশ যুদ্ধের এই মিথ্যা আখ্যানগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ বাংলাদেশির জাতীয়তাবাদী গৌরবকে আঘাত ও অপমান করেছে। ভারত ও পাকিস্তানের অংশে বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের এমন মিথ্যাচার ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য শুভসূচনা হতে পারে না।

১৯৭১ সালে ভারত সরকারে নি:সন্দেহে কিছু বিবেকবান ব্যক্তি ছিলেন যারা খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন যে বাংলাদেশের জয় নিয়ে ভারতীয়দের খুব বেশি বড়াই সমীচীন হবে না। তারা সে সব ভারতীয় অতি উৎসাহীদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে তারা যেন স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের ভূমিকা নিয়ে বাড়িয়ে না বলে। তাদের মতে, বাংলাদেশ ছিল মুক্তিযুদ্ধের অর্জন।

ভারতের অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক শশাঙ্ক ব্যানার্জি ২০১৯ সালের জুলাই মাসে ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকে লেখেন যে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কয়েকদিন পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বেশি কৃতিত্ব না নেওয়া সংক্রান্ত ‘কূটনৈতিক মিশনে একটি গোপন বিজ্ঞপ্তি জারি করে’ ভারত সরকার।

ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সফল সমাপ্তির কৃতিত্ব ভারত বা ভারতীয় জনগণের নেওয়া উচিত নয়, কারণ বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য জীবন উৎসর্গ করেছে। তাই এই স্বাধীনতা বাংলাদেশের জনগণের অর্জন।’

তবে এই নির্দেশনা অধিকাংশ সদস্যই অনুসরণ করেনি। বরং তারা অব্যাহতভাবে দাবি করে আসছিল যে বাংলাদেশ ছিল ‘ভারতের সৃষ্টি’। এটি পরবর্তীকালে তাদের ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এবং বর্তমান ভারতীয় যুবকদের অধিকাংশই তা বিশ্বাস করে। এর ফলাফল খুব সুস্পষ্ট তা হলো তারা আশা করে যে বাংলাদেশ ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থের অধীন থাকবে। আর এখানেই ইতিহাস সচেতন বাংলাদেশিদের ক্ষোভ। ভারতের রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের একটি বিশেষ অংশের এমন মনোভাবই দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিনষ্ট হওয়ার কারণ বলে মনে করা হয়।

বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীরা বছরের পর বছর ধরে ভারতের এমন কুৎসিত বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের প্রতিবাদ করে আসছে। যদিও তাতে কোনো ফল হয়নি। এখানে উল্লেখ্য যে, ২০১৮ সালে প্রকাশিত কলকাতার স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী অশোক মিত্র তার অপিলা-চাপিলা গ্রন্থে লেখেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, শরণার্থী হিসাবে পূর্ব থেকে আসা পশ্চিমা বাঙালিদের মনোভাবে পরিবর্তন হয়। বিষয়টি এমন যে তারা বাংলাদেশে তাদের জমিদারি ফিরে পেয়েছে’। অশোক মিত্র এটাকে বিপজ্জনক বলে মনে করেন। এবং তিনি একটি নিবন্ধে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশের প্রতি ‘সহানুভূতিশীল উদাসীনতার নীতি’ অবলম্বন করার পরামর্শ দেন। যে বাংলাদেশিরা আমাদের কাছে নতজানু হবে না এবং মাথা নত করবে না কারণ আমরা তাদের স্বাধীনতা পেতে সাহায্য করেছি; এটা আমাদের দুজনের জন্যই ভালো হবে যদি আমরা একটু দূরত্ব রাখি এবং তাদের ব্যাপারে খুব বেশি নাক না গলাই। তবে তার সেই পরামর্শ ভারতীয় কর্ত‍ পক্ষ আমলে নেয়নি।

তার মতে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এখনও ভালো পরামর্শের প্রতি মনোযোগ দিতে নারাজ। তার স্পষ্ট প্রমাণ মেলে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির প্রভাবশালী নেতা দিলীপ ঘোষ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মুখ্যমন্ত্রী সম্বোধন করার মধ্য দিয়ে। সে সময় শেখ হাসিনা উপস্থিতিতেই দিলীপ ঘোষ তাকে ‘একজন মুখ্যমন্ত্রী’ বলে উল্লেখ করেন।

ভোটাধিকার হরণে ভারতের হস্তক্ষেপ ও জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া

আওয়ামী লীগ সরকার ক্রমাগত ভাবে দাবি করে আসছে যে, গত দেড় দশকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। কিন্তু দেশের রাজনীতি সচেতন মহল নিদর্শন খুঁজে পাচ্ছেন না। বিষয়টি মোটা দাগে লক্ষণীয় যে, ভারত সীমান্তে অনুপ্রবেশ বন্ধের নামে নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। দুই দেশের মধ্যকার অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানি আটকে রেখে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারত এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পণ্য পরিবহন সুবিধা নিলেও সেক্ষেত্রে শুল্ক দিচ্ছে না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো ভারত তাদের গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে এক তরফাভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে। যা বস্তুত বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মৌলিক রাজনৈতিক অধিকার হরণের নামান্তর।

২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে। এর প্রতিবাদে বাংলাদেশের সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয়। অথচ ১৯৯৬ সালেই এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধানটি পাশ করতে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে বাধ্য করেছিল।

২০১৪ সালের ওই নির্বাচনে না যেতে প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ভারত জাতীয় পার্টিকে বাধ্য করে। অবশেষে সকল আন্দোলন ও বর্জনকে উপেক্ষা করে ওই দেশে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

এরপর এলো ২০১৮ সালের নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিএনপিসহ অন্যান্য দল শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সম্মত হয়। এসময় আওয়ামী লীগ ও তার ভারতীয় বন্ধুরা সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিলেও ভোটের আগের রাতে (২৯ ডিসেম্বর রাত) ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়। অভিযোগ রয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা সরাসরি আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে দিয়ে কারসাজি করায়।

এরপর আবার একটি নির্দলীয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে দেশব্যাপী জন আন্দোলন গড়ে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু পশ্চিমা শক্তিগুলোও জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানাতে ক্ষমতাসীনদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু এবারও আওয়ামী লীগ ভারতের দ্বারস্থ হয়। ২০২৩ সালের আগস্টে দিল্লি সফরের সময় তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য যা যা করা দরকার তাই করতে ভারত সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও তাদের প্রতি ভারতের অবৈধ সমর্থনের বিষয়টি অস্বীকার করেননি। গত বছরের অক্টোবরে এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের একটি গোপন সমঝোতায় ভারত সহায়তা করেছে।

এসব কারণেই দেশপ্রেমিক বাংলাদেশি নেটিজেনদের একটি অংশ ‘ভারতীয় পণ্য বয়কট’ আন্দোলন শুরু করে। যা খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়েছে। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিশ্বায়নের এই যুগে বেশিরভাগ দেশই পুরোপুরি না হলেও অন্যান্য দেশের পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ এমনকি ভারতও এর ব্যতিক্রম হতে পারে না। ভারতীয় পণ্য বর্জনের এই আন্দোলন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাদের আধিপত্যবাদী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থানই বলা যায়।

গত দেড় দশক ধরে দেশের কোটি কোটি মানুষ ভারতের কারণেই যে ভোটাধিকার বঞ্চিত রয়েছে এটি এখন পানির মতোই পরিস্কার। যে সমস্ত অদূরদর্শী ভারতীয় নীতি-নির্ধারকরা সমগ্র ভারতকে অধিকাংশ বাংলাদেশির চোখে শত্রু হিসেবে পরিণত করেছেন এবার তাদের একটু বিরতি নেওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরেুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল বৈষম্য, শোষন ও নিগ্রহের বিরুদ্ধে। তারা ভারতের অধীনস্থ হওয়ার জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াই করেনি।

লেখক: নূরুল কবীর, সম্পাদক দ্য নিউএজ। পত্রিকাটির স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় প্রকাশিত বিশেষ নিবন্ধ হতে সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত রূপ; ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন মেসবাহ শিমুল।

Credit: Bangla Outlook

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here