বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

0
32

আরিফুল হক

আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি গুণী নির্মাতা, পরিচালকের সংগে কাজ করার এবং সম্মানজনক সখ্যতা আমার আছে। আজকের ঘটনাটি একটি ছবিকে কেন্দ্র করেই। যারা আমার অভিনেতা পরিচয় জানেননা বা ভুলে গেছেন তাদের জন্য ছোট্ট পরিচিতিটুকু দিয়ে মূল ঘটনায় যাই!

বাংলাদেশের একজন নামকরা পরিচালকের আউটডোর শুটিং এর কাজে আমাকে একবার ফরিদপুর জেলার নদী নালায় ঘেরা অপূর্ব একটি গ্রামে গিয়ে কয়েকদিন থাকতে হয়েছিল! গ্রামটি ছিল ভারতীয় সীমান্তবর্তী। এবং নিম্নবর্ণের তফসিলি হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল। এখানে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা বাস করলেও সকলেই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। ওরা রসিকতা করে বলতেন ‘এ গ্রামের ভিখারিও এম এ পাশ’! সত্যিই তাই! গ্রামটির শিক্ষার ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। ঐ গ্রামে একটি কলেজ আছে যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন সে যুগের কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। আমাদের আউটডোর শুটিং টিমে নায়ক নায়িকা (বিশেষ কারনে নাম উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকছি) সকলেই ছিল। এবং সকলের থাকার মত সুব্যবস্থাও করা হয়েছিল। ওখানে গিয়ে লক্ষ্য করলাম নামকরা চলচ্চিত্রাভিনেতাদের চাইতে টিভি অভিনেতা হিসেবে আমার পরিচিতি যেন বেশি! ঐ গ্রামে সিনেমা হল ছিল কিনা জানিনা, তবে প্রায় প্রত্যেক বাড়ীতে যে টিভি ছিল, সেটা পরে টের পেয়েছিলাম। হয়ত সেই কারনেই গ্রামবাসী আমাকে দেখার জন্য ভিড় জমাতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরই ডাইরেক্টর সাহেব অল্প বয়সী এক তরুণকে সাথে নিয়ে এসে বললেন, ‘আরিফ ভাই! এখানে আমাদের সাথে আপনার থাকা হবেনা।’ জিজ্ঞেস করলাম, কেন? উনি হেসে বললেন, আপনিতো এখানকার হিরো, দেখছেননা ভক্তদের ভীড়! এই কুঁড়ে ঘরে কি আপনার ভক্তরা থাকতে দেবে আপনাকে! এই ছেলেটি এসেছে তাদের বাড়ীতে আপনাকে রাখার বায়না নিয়ে। আমি যেতে চাইলামনা! ডাইরেক্টর সাহেব বললেন ছেলেটির পিতা এখানকার স্কুলের হেডমাস্টার, খুবই সম্ভ্রান্ত এবং সকলের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। আপনি তাঁর খুব পছন্দের মানুষ, এই দেখুন চিঠি লিখে ছেলেকে পাঠিয়েছে। যান! ওখানে ভাল লাগবে আপনার।

ছেলেটির অনুরোধ এবং ডাইরেক্টর সাহেবের নির্দেশে গিয়ে উঠলাম হেডমাস্টার সাহেবের বাড়িতে। হেডমাস্টার সাহেব ছিলেন হিন্দু শিডিউল কাস্ট ভুক্ত। এবং বাংলাদেশ সিডিউলকাস্ট হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। অনেকখানি জায়গা নিয়ে মাটির প্লিন্থের উপর বেশ বড় চার কামরার টিনের বাড়ি। সামনে আম, কাঁঠাল, আতা, বেল ও জাম গাছের ছায়া ঘেরা এক খন্ড প্রশস্ত উঠান। পরিষ্কার লেপা মোছা ছবির মত বাড়িটা। হেডমাস্টার সাহেব, তার স্ত্রী আর দুই ছেলে! এক ছেলে বিদেশে পড়ছে, সাথে এক কলেজ পড়ুয়া ছেলে নিয়ে তিনি এই বাড়িতে বাস করেন। এরা সকলেই অমায়িক, মিশুক, এবং দিলখোলা মানুষ!

বাড়িতে আসার সাথে সাথে সকলে যেন আপন মানুষ হয়ে গেলেন। শুটিং এর অবসরকালীন সময়টা ওনাদের সঙ্গে, এবং গ্রামের অন্যান্য মানুষের সাথে আলাপচারিতা, গানে গল্পে বেশ আনন্দেই সময় কাটতে লাগলো। একদিন সন্ধ্যায় শুটিং থেকে ফিরে দেখি হেডমাস্টার সাহেবের উঠানে বেশ কিছু মানুষ জড় হয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু আগন্তুক যাঁদের হাতে ছিল পোস্টার আর লিফলেট। আমাকে দেখে হেডমাস্টার সাহেব বললেন আপনিও আসুন! এখানে বলে রাখি, গ্রামটি ভারতীয় সীমান্তবর্তী হওয়ায় এখানের মানুষ পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই এপার ওপার যাওয়া-আসা করতে পারতো। যে কারনে এই গ্রামে স্বাধীন বঙ্গভূমি নামক বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বেশ তৎপরতা ছিল। আমি দেখলাম, বাইরে থেকে আসা আগন্তুকরা তাদের লিফলেট এবং প্রচার পুস্তিকা বিতরণ করার পর বোঝাতে লাগলেন কেন তারা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল জুড়ে অর্থাৎ বরিশাল, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া ফরিদপুর, পাবনা, দিনাজপুর নিয়ে স্বাধীন বঙ্গভূমি নামক হিন্দুরাজ্য গড়ে তুলতে চায়। আমি ওখানে গিয়ে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম! যাইহোক! আগন্তুকদের দীর্ঘ বক্তৃতা শেষ হবার পর তারা হেডমাস্টার সাহেবের মতামত জানতে চাইলেন। হেড মাস্টার সাহেব বললেন, আমার মতামত নয়। কিছু প্রশ্ন আছে আপনাদের কাছে। করতে পারি? তারা বললো অবশ্যই, করুন!

হেডমাস্টার সাহেব বললেন, আমার প্রথম প্রশ্ন হল, আপনাদের কথিত বঙ্গভূমির সাথে কি পশ্চিমবঙ্গের স্বাধীনতাও যুক্ত আছে? নাকি, বাংলাদেশের কিছু অঞ্চল বিচ্ছিন্ন করে ভারত ভুক্তির কথা ভাবছেন? বঙ্গভূমির বক্তারা একটু হতচকিত হয়ে গেলেন! বললেন পূর্ববাংলা থেকে বাড়িঘর ফেলে যারা পশ্চিম বঙ্গে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে তাদের বসবাসের জন্য বাংলাদেশ থেকে কিছু অঞ্চল কেটে নিয়ে আমরা স্বাধীন বঙ্গ ভূমি রাজ্য গঠন করতে চাই। হেডমাস্টার সাহেব বললেন, আমি দেখতে পাচ্ছি, ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হিন্দুবঙ্গ চাওয়ার কারনে, বিশাল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য আজ আর্য-ভারতের হাতে বন্দী হয়ে আছে। আপনারা কি মনে করেন আপনাদের ক্ষুদ্র দূর্বল স্বাধীন বঙ্গভূমি রাজ্য স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারবে? ভারতের থাবা থেকে বর্তমান বাংলাদেশ রাজ্যটিই যখন স্বাধীনতা রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন আপনাদের ক্ষুদ্র রাজ্য স্বাধীন বঙ্গভূমি স্বাধীন থাকতে পারবে কি করে?আমার পরের প্রশ্ন, জন্মলগ্ন থেকেই ভারতবর্ষের জনসংখ্যার মাত্র তিনভাগ ব্রাহ্মণ। সেই ব্রাহ্মণদের হাতে ভারত শাসিত হয়ে আসছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে হলে তাকে ব্রাহ্মণ হতেই হবে এ যেন এক অলিখিত বিধান! ভারতে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের কোন মর্যাদাই নেই। বর্তমান বাংলাদেশের আমরা অধিকাংশ হিন্দু নিম্নবর্ণ তফসিলি সম্প্রদায়ভুক্ত হিন্দু বাস করি, তাদের টেনে নিয়ে ভারতের সাথে জুড়ে দিলে পুনরায় তারা ভারতীয় ব্রাহ্মণদের দাস হয়ে পড়বেনা কি? যতদূর জানি আপনারাও তো দাস এবং মালাকার শ্রেণীভুক্ত নিম্নবর্ণের হিন্দু। ভারতীয় আইনে আপনাদের জন্য কি সুযোগ সুবিধা রাখা হয়েছে আমাদের একটু বলতে পারবেন কি? দেখুন আমারও বয়স হয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে এখানে উপস্থিত সকলের জন্য কয়েকটা কথা বলি। বাংলাদেশের এই গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে আদিকাল থেকেই নিম্নবর্ণের হিন্দু অর্থাৎ জেলে, মাঝি, কামার-কুমার, ছুতার, লোহার, চামার, ধোপা, রজক, প্রমানিক, রাজবংশী, কেয়ট, মালাকার, দাস প্রভৃতি নমঃশূদ্র শ্রেণীর অধিবাস। ভারত যাঁদের তফসিলি আখ্যা দিয়েছে, সেই নিম্নশ্রেণীর তফসিলি সম্প্রদায়ের হিন্দুরাই এখানে শতকরা ৯৫ জন। বাংলাদেশে জাতপাতের বিভেদ না থাকায়, এই নিম্নবর্ণের হিন্দুরা এখানকার সংখ্যাগুরু মুসলমানদের সাথে দীর্ঘদিন ধরে সমমর্যাদা নিয়ে বাস করে আসছে। যেমন ধরুন, আমি নিজে একজন তফসিলি সম্প্রদায়ের হিন্দু হয়েও এখানে স্কুলের হেডমাস্টার। আমার কাছে উচ্চবর্ণের হিন্দু-মুসলমান উভয় ছাত্রই পাঠ নিচ্ছে, কেউ অসম্মানের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে না। তাছাড়া আমার এক ছেলে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়তে গেছে। সে ক্ষেত্রেও জাত-বর্ণের প্রশ্ন ওঠেনি। আপনারাই বলুন নিম্নবর্ণের হিন্দুদের জন্য বিশাল ভারতে এই সুযোগ কি আছে? আমাকে ১মিনট সময় দেন, বলে তিনি রুমে গিয়ে কয়েকটা পুরানো খবরের কাগজ নিয়ে এসে দেখিয়ে বললেন আপনাদের সবার অবগতির জন্য এই ভারতীয় পত্রিকা থেকেই কয়েকটি স্ট্যাটিসটিকস তুলে ধরতে চাই। নয়াদিল্লী থেকে এ এফ পি পরিবেশিত এক খবরের উদ্ধৃতি তুলে তিনি বললেন গত ২৩-৮-৯৭ তারিখে এএফপি জানাচ্ছে যে, (যেখানে নিম্নবর্ণের হিন্দু সরকার গঠিত হয়েছে) উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মন্দিরে প্রবেশ করতে দেয়নি। সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের মূহুর্তে এই ঘটনা ঘটে! হেডমাস্টার সাহেব বললেন, সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী ভারতে ব্রাহ্মণদের সংখ্যা ৩% মাত্র। অথচ ভারতের রাজনীতি, আমলাতন্ত্র, শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-ব্যনিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে ব্রাহ্মণদের সংখ্যা ৮৫%। ব্রাহ্মণ ছাড়া হিন্দু জাতের আর কয়েকটা উঁচু বর্ণের মানুষ একত্রিত করলেও তাদের সংখ্যা ১৫% হবে না। এই ১৫ ভাগ মানুষই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারতের ৮৫% নিম্নবর্ণের হিন্দুসম্প্রদায়ের উপর শোষণ শাসন অত্যাচার চালিয় আসছে।

ভারতের নিম্নবর্ণের হিন্দুরা সেথায় পশুর থেকেও অধম জীবন যাপন করে। তাদের শিক্ষা নেই, চাকরি নেই, কোন ব্যবসা নেই। তারা কুয়ায় জল আনতে পারেনা, দোকানে বসে চা পান করতে পারেনা, এমনকি কোথাও কোথাও নারিকেলের মালা বুকে ঝুলিয়ে পথ হাঁটতে হয় যাতে তাদের থুতু পড়ে পথ অপবিত্র না হয়ে যায়। ভারতের নিম্নবর্ণের হিন্দুরা, হিন্দু ব্রাহ্মণ এবং উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাতে, ‘অস্পৃশ্য’ নামে যে অমানবিক সামাজিক বৈষম্য, অসম্মান, এবং পীড়নের শিকার হন, পৃথিবীর কোন দেশ, সমাজ, এমনকি ইউরোপে ক্রীতদাস প্রথা আমলেও তেমন অমানবিক নির্যাতনের নজীর পাওয়া যাবেনা! এই কিছুদিন আগে পুনার গোখলে ইন্সটিটিউট মহারাষ্ট্রের ৮টি জেলার উপর এক সমীক্ষা চালিয়ে জানতে পেরেছিল যে, সেখানে ৯০% অস্পৃশ্য পরিবারকে গ্রামের সীমানার বাইরে নারকীয় পরিবেশে থাকতে বাধ্য করা হয়। সেই অস্পৃশ্যদের জন্য মাত্র ৫০% মানুষের টিউবওয়েল কলের জলের ব্যবস্থা আছে। বাকিরা অন্যদের টিউবওয়েলের কাছে পর্যন্ত যেতে পারেনা। বলুন এই কি একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতা? আপনার অনেকেই হয়ত ভারতের মন্ডল কমিশনের কথা জানেন। ভারতের তফসিলি শ্রেনী ভুক্ত নিম্নবর্ণ হিন্দুদের সামান্য কিছু সুযোগ-সুবিধা দানের সুপারিশ করে এই মন্ডল কমিশন, ১৯৮০ সালে এক রিপোর্ট ভারত সরকারের কাছে পাঠিয়েছিলেন। বাম্ভনরা সেই সামান্য সুযোগ-সুবিধাগুলোও কার্যকর করতে দেয়নি। ১৯৯০ সালে ভি পি সিং সরকার মন্ডল কমিশন রিপোর্ট মেনে নেয়ার ফলে ব্রাহ্মন্যবাদীরা ভিপি সিং সরকারের পতন ঘটিয়ে ছাড়ে। মন্ডলকমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মনরা আদালতে মামলা পর্যন্ত করেছিল। সুপ্রিমকোর্ট মন্ডলকমিশনের পক্ষে রায় দেয়ার ফলে বাম্ভনরা বেকায়দায় পড়ে যায় এবং বাবরী মসজিদ ভাঙার মত ঘৃণ্য উত্তেজনা সৃষ্টি করে মন্ডলকমিশনের রায় চাপা দিতে সক্ষম হয়।ভারতের সামাজিক বিভাজন যেখানে এত অমানবিক সেখানে বাংলাদেশের হিন্দুদের ভারতভূক্ত করে ব্রাহ্মণদের সেবাদাস বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কি লাভ করবেন আমাদের বলতে পারেন?

ভারত তার দেশের নিম্নবর্ণ হিন্দুদের দারিদ্র, নিরক্ষরতা, অস্পৃশ্যতা, এবং বস্তি জীবনের অভিশাপ ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি। ভারতের দলিত নেতা পেরিয়ার ইভি রামস্বামী বলেছিলেন “ব্রাহ্মণরা শূদ্র দের ঘৃণা করে! কিন্তু রাজ্য দখলের ক্ষেত্রে বা সংখ্যালঘু দমনের ক্ষেত্রে তাদের কাজে লাগায়।” একথা অতীতেও যেমন সত্য ছিল আজও তেমনি সত্যি, যেমন আপনাদের তারা কাজে লাগাচ্ছে। পেরিয়ার রামস্বামী ব্রাহ্মণদের কার্যকলাপে এতই মর্মাহত হয়েছিলেন যে তিনি ভারতীয় নিম্নবর্ণের হিন্দুদের হিন্দুধর্ম ত্যাগ করার উপদেশ দিয়েছিলেন!

ভারতের খসড়া সংবিধান রচনাকারী বাবা সাহেব ডঃ আম্বেদকরের কথাতো আপনারা জানেন।

এই গুনি ব্যক্তিটি জাতিতে নিম্নবর্ণের ‘মাহার’ শ্রেনীভুক্ত হওয়ায় বর্ণ হিন্দুদের দ্বারা কি ভাবে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন! ঐসব লাঞ্ছনা থেকে বাঁচার জন্য তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করতে চেয়েছিলেন। পরে গান্ধীজীর অনুরোধে তাঁর তিন লাখ অনুসারী সহ তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন।

মাস্টার সাহেব কিছুটা আবেগ তাড়িত হয়ে বলতে লাগলেন ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পূর্ব বাংলাকে অচল করে দেয়ার জন্য আপনাদের এই ব্রাহ্মণ নেতারা সোনার হরিণ দেখিয়ে এদের মাটির মানুষদের ওপারে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ-কায়স্থরা ঠিকই বাড়ী পেয়েছে, প্লট পেয়েছে, ব্যবসা পেয়েছে, রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু কয়জন নিম্নবর্ণের হিন্দু সেখানে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। এই পঞ্চাশ বছর পর আজও তাদের অনেকে শিয়ালদহ স্টেশনে, কলকাতার ফুটপাথে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বন্ধুরা আমরা এখানে ভাল আছি। এখানে রহীম হাজী আর রমেশ তেলি একই পাড়ায় ঘর বেঁধে বাস করি। একে অপরের দুঃখে দুঃখী, সুখে সুখী হই, হাতে হাত, বুকে বুক মিলিয়ে দিনযাপন করি। কেউ প্রশ্ন করেনা কার জাত কি? একই টিউবওয়েলে জল খাই, ছোঁয়া লাগলে কেউ কলস ফেলে দেয়না। এখানে যোগ্যতা থকলে ক্যায়টের ছেলেও সিএসপি অফিসার হতে পারে, কেউ তাকে বাধা দিতে আসেনা। একটা কথা মনে রাখবেন ভারতের রাজনীতিতে ব্রাহ্মণ্যবাদের একত্ববাদ যতদিন থাকবে ততদিন তাদের বর্ণবৈষম্য আর সাম্প্রদায়িকতাকে জিইয়ে রাখতেই হবে। সেই জন্যই তো ডঃ আম্বেদকর ক্ষুব্ধ চিত্তে তাঁর “এ্যানিহিলেশন অফ কাস্ট” বইতে লিখেছেন, ‘তুমি যদি জাত ব্যবস্থাকে ভাঙতে চাও তবে বেদ এবং শাস্ত্রগুলোকে, যা কোন যুক্তিকে স্বীকার করেনা, যা নৈতিকতাকে অস্বীকার করে, ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিতে হবে। তোমাকে অবশ্যই ধংস করতে হবে স্মৃতি অনুসারী ধর্মকে।”

Annihilation of Cast বইটি ডঃ আম্বেদকর বাবা সাহেবের একটি বহু পঠিত, বহু আলোচিত বই, পড়া না থাকলে দয়া করে পড়ে দেখবেন!

লেখক: বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বহু গ্রন্থের লেখক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here