বর্তমান চলমান নির্বাচনী ট্রেনের গন্তব্য কোথায়?

0
112

বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে ১৫ই নভেম্বর তফসিল ঘোষণা মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে বা ধারাবাহিকতায় অভিনব একটি ভাগবাটোয়ারার নির্বাচন জাতির দরজায় কড়া নাড়ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এমন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কমপক্ষে তিনদিন পূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সম্ভবত সর্বশেষ সংলাপ, সমঝোতা এবং অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে বিএনপি আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নিকট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিস্টার লু একটি পত্র প্রেরণ করেন। যে পত্রটি চূড়ান্ত এবং সর্বশেষ বার্তা হিসেবে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিস্টার পিটার হাস্ বিএনপি, আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির কাছে পৌঁছে দেন। তবে বিএনপি জাতীয় পার্টি যথাসময়ে পত্রটি গ্রহণ করলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পত্রটি গ্রহণ করতে অত্যন্ত সুকৌশলে সময়ক্ষেপণ করেছেন। এমনকি দেখা যায় তফসিল ঘোষণার দিন শাসক দলের সাধারণ সম্পাদক মিস্টার ওবায়দুল কাদের পত্রটি গ্রহণ করেন। যা অনেকটা চিঠিটিকে এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল হিসেবে অনেকে বিবেচনা করেছেন। বলতে গেলে আনুষ্ঠানিকভাবে সেদিন থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজনের জন্য উৎসাহ প্রদানের ক্ষেত্র থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেন।

ক্ষমতাসীনদের মনোভাব নিশ্চিত হয়েই তারপর দিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিস্টার হাস প্রায় দুই সপ্তাহের অবকাশকালীন ছুটিতে চলে যান। পক্ষান্তরে এই ঘটনার মধ্যদিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অথবা অনেকটা ভেবেচিন্তে সুকৌশলে বর্তমান আওয়ামী লীগ শাসক বাংলাদেশকে চূড়ান্তভাবে ভূ-রাজনীতির মাঠে নিয়ে আসেন অর্থাৎ একদিকে চীন-ভারত-রাশিয়াকে পাশে রেখে অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে ঠেলে দিয়ে ভূ-রাজনীতিতে একটি বিভাজন রেখা টেনে দেন। যার ফলশ্রুতিতে একটি অংশের নেতৃত্বকারী দেশ হিসেবে রাশিয়া একাধিকবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে বিবৃতি দিয়েছে।

মস্কোর এই ধরনের মনোভাবের প্রতি ভারত এবং চীনের ‘ইন্ধন’ রয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। এখানে বলাইবাহুল্য ঐতিহাসিকভাবে চীন এবং ভারত দুই মেরু ও মেরূকরণে একে অপরের প্রতিপক্ষ হলেও ‘এক অদৃশ্য অজানা’ কারণে বাংলাদেশ প্রশ্নে এই দুই পরাশক্তি একটি সমান্তরাল রেখায় অবস্থান করায় আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণদেরও বিস্মিত করেছে। যাহা একটি গবেষণারও দাবি রাখে।
২। গেল কয়েক মাসে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে অদ্যাবধি বিভিন্ন সভা সমাবেশে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মিত্রদের অনেক বাঘা বাঘা নেতারা একাধিকবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘অপ্রমাণিত’ বিভিন্ন অভিযোগ উপস্থাপন করেছেন। যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে চাওয়া, এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার অপতৎপরতা লিপ্ত, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে মার্কিনিদের অসহযোগিতা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা ইত্যাদি। এসবগুলোই রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে উত্থাপিত হওয়ায় নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই এসব অভিযোগ জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশ্লেষকরা মনে করেন; বাংলাদেশিদের আকাক্সক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগামী জাতীয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য সরকারকে যে উৎসাহ প্রদান করে আসছিল সেই বিষয়টিকে ভিন্ন দিকে ধাবিত করার জন্য বর্তমান শাসক শ্রেণি এসব অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। বলা যায়; আওয়ামী লীগ সরকার এখনো প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের মনোজগতে বুনে দিতে যে, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই উৎসাহ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ এবং যার নেপথ্যে রয়েছে মার্কিনিদের গভীর ষড়যন্ত্র।’ সরকার এই অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত করতে তার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াগুলোকেও ব্যবহার করে চলেছে। অনবরত।
কিন্তু এতসবের পরেও বাংলাদেশের বর্তমান শাসক শ্রেণি দেশের জনগণ এবং পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।

৩। কিন্তু অন্যদিকে রাশিয়া ভারত চীনের তৎপরতা, বক্তৃতা বিবৃতি, অবস্থান এমনকি চীন ভারতের নীতি নির্ধারক পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের দৃশ্যমান অদৃশ্যমান আসা-যাওয়া; আনাগোনাকে বর্তমান শাসক শ্রেণি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ হিসেবে মোটেই ভাবতে চান না: বরং এসব কর্মকাণ্ডকে বা আসা-যাওয়াকে সরকার আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে এক ধরনের স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন।
আর এই বিষয়গুলো স্বাধীন বাংলাদেশিরা বরাবরের মতোই বাঁকা চোখে দেখাচ্ছে। অন্যদিকে এসব চলমান ঘটনা প্রবাহ যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের উদ্বিগ্নতাকে গভীর থেকে গভীরতর করছে।
ফলে অনির্দিষ্ট অলিক গন্তব্যের এই পথে আপাতত আওয়ামী লীগ সরকার কিছুটা ‘স্বস্তি বোধ’ করলেও মূলত নিজের অজান্তেই এই শাসকগোষ্ঠী ক্রমেই ভূ- রাজনীতির চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে।

আরও কিছু সম্পূরক উদ্দামতা তৈরি করেছে! যখন বাংলাদেশ আরেকটি পাতানো নির্বাচনের ট্রেনে যাত্রা শুরু করেছে তখন। যেমন অতি সম্প্রতি ও নীরব যুক্তরাষ্ট্র নড়বরহম বিক্রয় এবং মার্কিন তেল কোম্পানি xxoon Mobil কে বিশেষ সুবিধা দেয়ার জন্য মার্কিন রাষ্ট্রদূত সরকারের সঙ্গে দেনদরবার অথবা দৌড়ঝাঁপ করছে (অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অফিসিয়াল টুইট বার্তায় এই ধরনের ডিলের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি) বলে ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় একটি ‘বিশেষ শ্রেণি’ প্রোপাগান্ডা চালিয়ে গেলেও পক্ষান্তরে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাকারোভার বিবৃতি, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে আরব বসন্ত ঘটাবে এমন মন্তব্য অথবা ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মিস্টার এম জে আকবরের বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসে একটি বিশেষ দলের প্রশংসা করা, এমনকি বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ধারায় আছে এবং ভারত ও সরকারের পাশে আছে এমন বক্তব্য দেয়া সাম্প্রতিক বক্তব্যের বিষয়ে অথবা চীনের বিভিন্ন ব্যক্তির বর্গের অদৃশ্যমান আনাগোনার ‘রহস্য-চুক্তি অথবা যুক্তি’ সম্পর্কে বর্তমান আওয়ামী লীগ একেবারে নিশ্চুপ। উল্লিখিত বিষয়গুলো স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ কিনা এখন এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। তাই আওয়ামী লীগের এমন ‘রহস্যজনক নীরবতায়’ পরাশক্তির একপক্ষকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার ‘নেপথ্যের ঘটনা প্রবাহ’ নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মনে অনেক বড় বড় প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কারণ দিনশেষে বাংলাদেশটা ১৮ কোটি জনগণের।

৪। এই মুহূর্তে অপর পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ‘রহস্যজনক নীরবতার’ ফলে বর্তমান শাসক দলের তত্ত্বাবধানে আগামী ৭ই জানুয়ারির ‘ভাগবাটোয়ারার আয়োজিত’ নির্বাচনটির সফল সমাপ্তি নাও হতে পারে।

৫। কারণ; ইতিমধ্যে নির্বাচনটি যে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক এবং আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছে না তা একেবারেই দেশে-বিদেশে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। জাতীয় পার্টিসহ কথিত কিংস পার্টি নিয়ে খেলাধুলার কারণে সরকারের অবস্থা এখন লেজেগোবরে।

এ ছাড়া অন্তত গেল ২৮শে অক্টোবর বিরোধী দলের ওপর পরিকল্পিত ক্র্যাকডাউন শুরুর পর থেকে ১৭ই ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার দ্বারা সংঘটিত অনেক ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ কর্মকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ওপর প্রচ্ছন্ন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার চাপ; এই ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ঘোষিত বাংলাদেশের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতি প্রয়োগ করার জন্য যে উপাদানগুলোর কথা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়েছে, তার প্রায় সব উপাদানই প্রতিফলিত হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। সর্বশেষ কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের অন্যতম নীতিনির্ধারক ড. আব্দুর রাজ্জাকের দেয়া সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এবং ভোটের মাঠে এক অভিনব রং লেপে দিয়েছে। যার জন্য বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে অনেক High price pay করতে হতে পারে! ফলে ‘বিরল নাটকীয়তায়’ পরিপূর্ণ চলমান নির্বাচনী তৎপরতা এবং ঝুঁকিপূর্ণ দেশের অর্থনীতির অবস্থার প্রেক্ষিতে ৭ই জনুয়ারি নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে কিনা হলেও তার পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা নিয়ে নানা ধরনের আশঙ্কা ও প্রশ্ন খুব জোরালোভাবে দেশে-বিদেশে উচ্চারিত হচ্ছে।

লেখক: জায়েদুল করিম চৌধুরী পলাশ
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও তরুণ শিল্প উদ্যোক্তা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here