পিলখানা ট্রাজেডি: বাবা দাড়িতে মেহেদী লাগাতেন, চিনতে কষ্ট হয়নি

0
47

ইতিহাসের ভয়াবহ-ন্যাক্কারজনক ও আত্মবিনাশী ট্রাজেডিগুলোর মধ্যে পিলখানার বিডিআর বিদ্রোহ নি:সন্দেহে অন্যতম। এক অর্থে এটিকে একমাত্র জঘন্য ঘটনাও বলা যেতে পারে। যে হত্যাকান্ড ঘটিয়ে একটি জাতির মেরুদণ্ডই কেবল ভেঙে দেওয়া হয়নি হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বও। একই সঙ্গে ৫৭ জন উচ্চ পদস্থ সেনা অফিসারকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করে একটি গোষ্ঠীকে পাকাপাকিভাবে ক্ষমতার মসনদে বসিয়ে দেওয়া হয়। পার্শ্ববর্তী প্রভাবশালী দেশটির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধনে সেদিনের সেই কথিত বিডিআর বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে মূলত একটি সাহসী প্রতিরক্ষা বাহিনীকে নপুংশকে পরিণত করা হয়েছে। এর ফলে ফায়দা হাসিল করেছে ওই দেশটি ও তাদের এদেশীয় দোসররা।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির রাজধানীর পিলখানায় ঘটে যাওয়া পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম ন্যাক্কার জনক হত্যাকান্ডে শহীদ হন কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম। যিনি দাপ্তরিকভাবে বিডিআরের প্রতিনিধি হিসেবে মহাপরিচালকের সঙ্গে একীভূত ছিলেন। একজন সাহসী ও সৎ কর্মকর্তা হিসেবে বিডিআরে তার যথেষ্ট সুনাম ছিলো। সেদিনের সেই বিভৎস ঘটনার বর্ণনা ধরেছেন তারই একমাত্র ছেলে আশরাফুল আলম হান্নান।

২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮ টায় পিলখানার কোয়াটার থেকে ধানমন্ডির ক্যাম্পাসে যাই পরীক্ষা দিতে। সে সময় আমি বিবিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র। তখনো পিলখানায় কোনো সমস্যা চোখে পড়েনি। বাবা সকালেই দরবার হলে চলে যান। বাসায় মা ছিলেন না। তিনি এক সপ্তাহ আগেই গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। বাসায় তখন আমার ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া ছোটো বোন, গ্রাম থেকে আসা মেঝো মামা ও কাজের মেয়েটি ছিলো।

শহীদ সুবেদার মেজর নুরুল ইসলামের ছেলে আশরাফুল আলম হান্নান

সকালের দিকেই বাসা থেকে ফোন দিয়ে পিলখানায় গোলাগুলি হচ্ছে বলে জানানো হয়। এর মধ্যেই ভার্সিটির প্রধান গেটে তালা মেরে দেয় প্রশাসন। রাস্তায় ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর গাড়ি টহল দিচ্ছে। বাসা থেকে জানালো তারা বাবার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছে না। আমিও চেষ্টা করে যাচ্ছি, কোনো ভাবেই তার কোনো খবর পাচ্ছি না।

পরে বিকেল নাগাদ সেখান থেকে ঝিগাতলায় চলে আসি। ইতোমধ্যে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। পিলখানার গেটগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। আমি লেকপাড়ে গেলাম। অনেক মানুষ। সবার চোখে মুখে আতঙ্ক। পিলখানার ভেতর থেকে থেমে থেমে গুলির আওয়াজ আসছে। আমি বাসায় যারা রয়েছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি।

একটা সময় আমাকে জানানো হলো বাবাকে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এমআই রুমের দিকে। আমার ছোটো বোন তখন ৩ তলা থেকে দৌড়ে নিচে নেমে আসছে। কিন্তু কিছু জওয়ান আমার বোনকে বাবার কাছে যেতে দেয়নি। তাদের মুখে লাল কাপড় বাঁধা ছিলো। তারা আমার ছোটো বোন জানায় বাবার পায়ে আঘাত লেগেছে। তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আসলে তখন বাবা মৃত। তাকে দরবার হলের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছিলো। কিন্তু দুইদিন পরেও আমরা বিষয়টি বুঝিনি। কোথাও থেকে তার ব্যাপারে কোনো তথ্য আমরা পাইনি।

আশরাফুল বলেন, ভেতরে ভেতরে এ ধরণের একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে এর আগে বিষয়টি বাবাও বুঝতে পারেননি। দরবার হলের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আমার বাবা আরো আমার বিবাহিতা দুই বোনকে বাসায় আসতে বলেছিলেন। আমার মাও সেদিন দুপুরে লক্ষীপুরের রামগতির গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন।

আমরা টেলিভিশনের খবরে বাবাকে খুঁজতাম। ঢাকার প্রতিটি থানা, হাসপাতালে বাবাকে হন্যে হয়ে খুজেছি। কিন্তু কোথাও তার কোনো হদিস পাইনি। তিনি যে মারা গেছেন তারও কোনো আলামত ছিলো না। প্রতিটি মিনিট যে কেমন অনিশ্চয়তায় কেটেছে তা বলে বোঝানো যাবে না।
ঘটনার কয়েকদিন পর পিলখানার একটি গণকবর থেকে ৪৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। যাদের মধ্যে আমার বাবা ছিলেন। আমরা এদিন তার লাশ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে গিয়ে শনাক্ত করি। বাবার মুখে দাড়ি ছিলো এবং তাতে তিনি নিয়মিত মেহেদী লাগাতেন। সাত দিন পরও তাকে চিনতে আমাদের কোনো কষ্ট হয়নি। বাবার কপালে একটি, বুকের ডান পাশে ২টি এবং বাম পাশে একটি গুলির চিহ্ন ছিলো।
২৭ বছরের কর্ম জীবনে সুবেদার নুরুল ইসলাম দেশপ্রেম ও দায়িত্বশীলতার অসংখ্য নজির রেখে গেছেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে দরবার হলে গোলযোগ শুরু হলে তিনি সবাইকে নিবৃত করার চেষ্টা করেন। সবাইকে থামাতে তিনি প্রাণপণে চেষ্টা চালান। তখনই তাকে হত্যা করা হয়।

আশরাফুল আলম হান্নান বলেন, বাবার মরদেহ বুঝে পাওয়ার পর আমরা আমাদের গ্রামের বাড়ি লক্ষীপুরে যাই। তখনও এই বিদ্রোহ নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা ধরণের কথাবার্তা প্রচলিত ছিলো। বিদ্রোহ থামাতে বাবার যে প্রচেষ্টা ছিলো তার কিছু কিছু বিষয় বিভিন্ন জনের মুখ হয়ে মিডিয়ায় চলে আসে। আমরা সেগুলো সংগ্রহ করি। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় তাই বাবার জানাজায় কোনো বেগ পেতে হয়নি। গ্রামবাসী প্রকৃত ঘটনা জানার পর শোকাভিভূত হন। পরে সরকারের পক্ষ থেকে বাবাকে শহীদ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। হত্যার শিকার ১০ জন বিডিআর সদস্যের মধ্যে আমার বাবাই একমাত্র শহীদ খেতাবপ্রাপ্ত।

চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় আশরাফুল। তখন সবে মাত্র ভার্সিটিতে পা রেখেছেন। বাবার হত্যা কান্ডের পর দিশেহারা হয়ে পড়েন। ছেড়ে দিতে হয় পিলখানার কোয়াটার। মায়ের সঙ্গে অবতীর্ণ হন কঠিন সংগ্রামে। ২০২০ সালে মাও পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এখন তারা পুরোপুরি এতিম। নানান ব্যস্ততায় গ্রামের বাড়িতে এখন একটু কমই যাওয়া হয়। তবে যখনই যান বাবার কথাই ঘুরেফিরে আসে। গ্রামের মানুষের কাছে অত্যন্ত সজ্জন-সদালাপী কেন্দ্রীয় সুবেদার পেশাগত জীবনে যেমন ছিলেন ন্যয়নিষ্ঠ ও দায়িত্ববান তেমনি গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছেও তার সুনাম ছিলো।

বিদ্রোহ প্রশমনে নুরুল ইসলাম শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছেন। যা ছেলে হিসেবে আমাকে গর্বিত করে। সেনাবাহিনী কিংবা বিডিআর একটা কঠিন নিয়মানুবর্তিতার ভিতর দিয়ে চলে বাবা সেটি অক্ষুণ্ন রাখতে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। ছেলে হিসেবে এর চেয়ে অহংকারের কি আছে? তবে আমি চাই এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হোক। আমার মতো ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো ন্যায় বিচার পাক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here