বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে। কিছুতেই লাগাম টানা যাচ্ছে না। কারণ প্রকল্প ব্যয় মেটাতে সরকারের কাছে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে নভেম্বর শেষে গ্রস নিট রিজার্ভ (জিআইআর) কমে ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ আরও কম। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবে রিজার্ভ রয়েছে ২৫ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার। তথ্যমতে, গত জুন শেষে রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ পাঁচ মাসের ব্যবধানে ৫ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার কমেছে। বর্তমানে যে রিজার্ভ রয়েছে তা দিয়ে চার মাসের কিছু কম সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চার দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির জন্য বাংলাদেশের প্রস্তাবটি আগামী সপ্তাহে সংস্থাটির বোর্ড সভায় অনুমোদনের জন্য তোলা হচ্ছে। বোর্ড সভার সময়সূচি অনুসারে, আগামী ১২ ডিসেম্বর ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির প্রায় ৬৮১ মিলিয়ন ডলার অনুমোদিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই কিস্তিটা পেলে কিছুটা বাড়বে দেশের রিজার্ভ। যদিও বাংলাদেশ আইএমএফের দু’ট শর্ত পূরণ করতে পারেনি। অন্যদিকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ৩২৭ মিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা আসার কথা রয়েছে। এই দুই ঋণ একত্রিত হলে ১ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
দুই বছর আগে ২০২১ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৪৮.০৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এরপর থেকে বৈদেশিক মুদ্রা তহবিলের যে ধারাবাহিক পতন শুরু হয়, তা আর কোনোভাবেই ঠেকানো সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির অঙ্ক ৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, সে হিসাবে প্রতিমাসে গড়ে ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন করে ডলার বিক্রি হয়েছে। গত ২ নভেম্বর পর্যন্ত ডলার বিক্রির অঙ্ক ছিল ৪ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার।
সূত্র জানায়, করোনার সময় দেশে রেকর্ডসংখ্যক প্রবাসী আয় আসে। তখন ডলার বাজার ও দাম স্থিতিশীল রাখতে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজার থেকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবে রিজার্ভ বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছেড়ে যায়। ২০২১-২২ অর্থবছর রিজার্ভ থেকে সব মিলিয়ে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছর (২০২২-২৩) বিক্রি করে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। এই ধারা অব্যাহত আছে চলতি অর্থবছরও। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন বা ৫৯০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব মিলিয়ে গত ১৭ মাসে রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক আগে বেসরকারি আমদানিকারকদের ডলার দিলেও এখন দিচ্ছে না। ফলে ডলারের জন্য ব্যাংকগুলোর শেষ আশ্রয়স্থল বলে কিছু নেই। ডলার-সংকটের কারণে আমদানির ঋণপত্র খোলা কমিয়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। বর্তমানে ছোট-বড় সব আমদানিকারকই ঋণপত্র খুলতে সমস্যায় পড়ছেন।
এদিকে রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য ডলার-সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো থেকে বেশি দামে কেনা ডলার কম দামে কিনছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকটের মধ্যে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম কমাতে বাধ্য করেছে ব্যাংকগুলোকে। ফলে চলতি মাসে ৭৫ পয়সা কমানো হয়েছে ডলারের ক্রয় ও বিক্রয়মূল্য। যদিও এই দামে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে কমই। এসব বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এই মুহূর্তে রপ্তানি বৃদ্ধি ও রেমিট্যান্স আহরণ বাড়ানো দরকার। তাছাড়া ডলারের দাম পরিবর্তনে এবিবি এবং বাফেদা ভিত্তিক সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। আর্থিক সংকট নিরসনে ডলার বাজার স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা খুবই জরুরি। এজন্য বিদেশি এই মুদ্রার দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াই শ্রেয়। কিন্তু কিছুদিন পর পর অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের সিদ্ধান্ত বাজারকে আরও অস্থির করছে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা শাখার সাবেক এই প্রধান।