গল্পটি ধরাবাঁধা চিত্রনাট্য অনুযায়ী সিনেমার সূত্রের মতো তরতরিয়ে এগুচ্ছে। যেমনটি সেলুলয়েড ঠিকরে প্রেক্ষাগৃহের রুপালি পর্দায় হয়। মূল ঘটনাকে ঘিরে থাকে তিনটি প্রধান চরিত্র: নায়ক, নায়িকা ও ভিলেন। বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিও এগুচ্ছে তিনটি প্রধান চরিত্রকে ভর করে: নির্বাচনমুখী ক্ষমতাসীন দল, তাদের অনুগামী দল ও স্বতন্ত্রগণ এবং নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো। সিনেমায় যেমন নায়ক, নায়িকা, ভিলেন সম্পর্কে আগাম আঁচ করা যায়। নির্বাচনী রাজনীতিতে সেটা পূর্বেই সঠিকভাবে আঁচ করা যায় না। নির্বাচনের পর নানা পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের ভিত্তিতে চরিত্রগুলো চিত্রিত হয়।
রাজনীতির মাঠে নিজে নায়ক হয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে কিংবা বিএনপি আওয়ামী লীগকে ভিলেন বানানোর চেষ্টা করছে। তাতে শেষ পর্যন্ত কে চূড়ান্তভাবে সফল হবে, এখনই বলা যাচ্ছে না। নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়া শেষে ভবিষ্যতের দিনগুলোতে তা নির্ধারিত হবে। বিশেষত, ইতিহাসের পাতায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানুষের অংশগ্রহণের হার, দেশে-বিদেশে বিশ্বাসযোগ্যতার মাত্রা ও সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হওয়ার মানদণ্ডের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে নায়ক ও ভিলেন।
বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর থেকে সহিংসতা ও হামলা-ভাঙচুরের যত অভিযোগ উঠেছে তার অধিকাংশই করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় এবার নৌকার বিপরীতে আওয়ামী লীগের নেতারাই বেশিরভাগ জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন এবং তাদেরই অভিযোগ নৌকার প্রার্থীর কর্মী সমর্থকদের বিরুদ্ধে। ফলে সন্ত্রাসের সঙ্গে মিশে আছে গৃহদাহের বিপদও।
উল্লেখ্য, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অন্তত ২২০টি আসনে সাড়ে তিনশর বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোটের মাঠে প্রার্থী হয়েছেন। এবার এমনও আসন আছে যেখানে নৌকার প্রার্থীর বিপরীতে চারজন আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এতে তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনা, যা প্রায়ই পারস্পরিক সন্ত্রাসে ও প্রবল গৃহদাহে রূপ নিচ্ছে।
এবারের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন ঠেকাতে ভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে এবং নির্বাচনে একধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করে অংশগ্রহণমূলক করতে আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে দলের নেতাদের ছাড় দিয়েছে। বিষয়টি দলীয় গঠনতন্ত্রের বাইরে গেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া কোনও নেতাকে শাস্তি দেয়নি আওয়ামী লীগ। ফলে, বিএনপি না আসা এবং ডামি প্রার্থী হওয়ার সুযোগে এবার নিজ দলের প্রতীক নৌকার বিপরীতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের শত শত নেতা। কিন্তু নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা শুরুর পর মাদারীপুর, ফরিদপুর, পিরোজপুর, নওগাঁ, বাগেরহাট, বরিশাল, কিশোরগঞ্জ, চট্টগ্রাম, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী সমর্থক তথা আওয়ামী ঘরানার কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হামলার ঘটনা ঘটছে।
শুধু তাই নয়, নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, নির্বাচনী সন্ত্রাসের মাত্রাও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিনই মিডিয়ায় নতুন নতুন মারপিট, হাঙ্গামা ও রক্তপাতের খবর আসছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই যদি নির্বাচনী পরিস্থিতি ক্রমবর্ধমান আকারে সন্ত্রাস কবলিত হয়, তাহলে প্রত্যাশিত শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের অপমৃত্যু ঘটবে। সন্ত্রাসের পটভূমিতে স্বাভাবিকভাবেই ভোটারদের অংশগ্রহণের হার হ্রাস পাবে এবং নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
তাই, নির্বাচনের প্রাক্কালে সন্ত্রাসের দানবীয় বাড়বাড়ন্ত অব্যাহত থাকলে তার মারাত্মক কুফল পুরো নির্বাচনকে নানাভাবে গ্রাস করবে এবং নির্বাচনকে বহুমাত্রিক বিপদের মুখে ফেলে দেবে। বিএনপিসহ দেশে-বিদেশে বর্তমান নির্বাচন প্রসঙ্গে সমালোচনা ও প্রতিবাদরত গোষ্ঠীর অভিযোগগুলোও তখন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে সামনে চলে আসবে। বিদ্যমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতির দিকে আঙুল তুলে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবির যৌক্তিকতা আরও জোরেশোরে প্রমাণের চেষ্টা করবে বিএনপি।
রাজপথে আন্দোলন করে বিএনপি যতটুকু ফায়দা পেয়েছে, তারচেয়ে বেশি লাভবান হবে নির্বাচনী সন্ত্রাসের কারণে সৃষ্ট জটিলতার সুবাদে। বিএনপি এবং গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, এলডিপিসহ যে ৩৭টি দল একই দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করেছে, তারা তাদের কণ্ঠস্বর উচ্চকিত করে আরও মুখর হওয়ার মওকা পাবে। বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা ‘রূপরেখা’ ও ১০ দফা দাবি আদায়ের ধারাবাহিকতায় ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ এবং ডিসেম্বরের শেষ প্রান্তে এসে ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জনসহ সরকারের বিরুদ্ধে ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ আন্দোলনকে যৌক্তিক ও সঠিক বলে দাবি করবে, যদি ভোটের মাঠে সন্ত্রাসের কারণে নির্বাচনের পরিবেশ ও পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং ভোটার অংশগ্রহণ কম হয়।
এমতাবস্থায়, নির্বাচন নিয়ে কূটনীতিকদের ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ তথা জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশের পক্ষে উচ্চারিত অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রত্যাশার বিষয়টিও শক্তিশালী আকারে পুনরুজ্জীবন হবে। যুক্তরাষ্ট্রের যে নতুন ভিসা নীতি ছিল নির্বাচনের পটভূমিতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়, তাও আবার প্রাধান্য পেতে পারে নির্বাচনী সন্ত্রাসের দৃশ্যপটে।
প্রধান বিরোধী জোটকে বাইরে রেখে এবার জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কারণে সামগ্রিক পরিস্থিতিকে অতীত নির্বাচনের মতো স্বাভাবিক বলা যায় না। এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগেরই নেতা। এর বাইরে জাতীয় পার্টি সমঝোতায় ২৬ আসনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ছাড় পেয়েছে। ছাড় পেয়েছে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও জেপির ৬ প্রার্থী। নির্বাচনের আগে কিংস পার্টি বলে পরিচিত তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম সারা দেশে প্রার্থী দিয়েছে। ফলে খেলা হচ্ছে মূলত এই পক্ষগুলোর মধ্যেই। তাতে ভিলেন রূপে দেখা যাচ্ছে সন্ত্রাসকে। এই ভিলেনকে বধ করতে না পারলে যাবতীয় চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে।
ড. মাহফুজ পারভেজ, লেখক ও গবেষক। প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।