বর্তমান সময়ের আলোচিত এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়- গার্মেন্টস শিল্প ও দেশের রপ্তানি আয়। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত হিসাবে বিবেচিত এই গার্মেন্টস শিল্প বা পোশাক খাতকে কালের বিবর্তনে আজ দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির সহায়ক স্তম্ভ বা পিলার বলা যায়। এক সময়ের টেইলারিং ব্যবসা আশির দশকের শুরু থেকে দেশের শিল্পপতি-বিজনেস আইকনদের সফল অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে রূপান্তরিত বা প্রতিষ্ঠিত এই পোশাক খাত আজ দেশের জিডিপির একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এই কারণে তিন দশকের বেশি সময় ধরে তৈরি পোশাক খাত রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের কর সুবিধা পেয়ে আসছে নিয়মিতভাবে। বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা ধরে রাখার লক্ষ্যের কথা বলে গার্মেন্ট মালিক বা তাদের সংগঠন সমূহ এখনো প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকার কর ছাড় আদায় করে নিচ্ছেন। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক প্রতিবেদনে জানানো হয় ২০২০-২১ অর্থবছরে পোশাক, বস্ত্র ও আনুষঙ্গিক খাতকে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকার কর ছাড় দেয়া হয়েছে। এর বাইরে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পোশাক খাতে করপোরেট করহার সবচেয়ে কম। পরিবেশবান্ধব বা সবুজ কারখানা হলে করপোরেট করহার মাত্র ১০ শতাংশ। শুধু তাই নয় রপ্তানিকারককে বছর শেষে এই কর সরাসরি দিতেও হয় না। রপ্তানিকালে মোট রপ্তানি মূল্যের (এফওবি মূল্য) উপর ১ (এক) শতাংশ উৎসে কর দিলেই তা পরে করপোরেট করের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়।
অথচ অন্য খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ২০ থেকে ৪৫ শতাংশ করপোরেট করহার প্রযোজ্য। এ ছাড়াও বিভিন্ন বাজার ভেদে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত নগদ সহায়তা, মূসক অব্যহতি ও রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নেয়া এবং বন্ড সুবিধাও পেয়ে থাকেন পোশাক খাতের ব্যবসায়ীগণ।
অতীতে অভ্যন্তরীণ ও দেশের বাইরের সংকটের মধ্যেও রাষ্ট্রের নানারকম সুবিধার ফলশ্রুতিতে ব্যবসা বা রপ্তানির ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা পোশাক খাত আজ এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। গার্মেন্টস শিল্প বা পোশাক খাতের বিদেশি অংশিজন-ক্রেতা প্রতিষ্ঠানসহ তাদের সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলি আজ নানা রকম কঠিন শর্ত আরোপসহ বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ বা দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে-যার সঙ্গে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ বা অস্তিত্ব জড়িত হয়ে পড়েছে। তাই আজ পোশাক খাতের ব্যবসায়িক উন্নয়নের সঙ্গে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে নানা প্রশ্ন এসে পড়েছে সুশাসনকে কেন্দ্র করে। মার্কিন শ্রমনীতি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিমালার দ্বিবার্ষিক পর্যালোচনাকে কেন্দ্র করে আজকের অনিশ্চয়তা বা অস্থিরতা কি একদিনে তৈরি হয়েছে? শ্রম অধিকার নিয়ে মার্কিন ঘোষণার পর পোশাক খাতের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বলে আসছেন নিষেধাজ্ঞা দেয়ার মতো পরিস্থিতি হয়নি। সরকারিভাবেও বলা হয়েছে শ্রম অধিকার বিষয়ে মার্কিন ঘোষণা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। পোশাক খাত নিয়ে সরকারের উদ্যোগে এক সভা শেষে জানানো হয় দেশের শ্রমনীতি যেসব পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা হয়েছে মার্কিন সরকারকে জানানো হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো শ্রম অধিকার নিয়ে মার্কিন ঘোষণা বিষয়ে চিন্তার কিছু নেই এমন অবস্থার পরও মার্কিন সরকার বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে নতুন করে ব্যাখ্যা তুলে ধরার প্রয়োজন হলো কেন?
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিমালার দ্বিবার্ষিক পর্যালোচনার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে পোশাক খাতের শীর্ষ এক নেতা জানিয়েছেন, পরিবেশবান্ধব বা সবুজ কারখানার সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সবার শীর্ষে। কিন্তু প্রশ্ন হলো পরিবেশবান্ধব বা সবুজ কারখানা কি এমনি এমনি তৈরি হয়েছে? সম্ভবত না। এর উত্তরের জন্য কল্পনায় হলেও ফিরে যেতে হবে ত্রিশ বছর আগের আমাদের দেশের গার্মেন্টস শিল্পের দৃশ্যপটে। বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ড-ক্রেতা ও পোশাক শিল্প খাতের আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর চাওয়া-পাওয়ার কারণেই তাদের সহায়তা এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আজকের পোশাক খাতের রম-রমা অবস্থা। এর জন্য অবশ্যই পোশাক শিল্প মালিকগণই কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। কেননা সেই লড়াইয়ে টিকতে না পেরে অনেকে কারখানা বন্ধ করে দিয়ে অন্য ব্যবসায় চলে গেছেন। বিগত এক যুগ সময়কালে তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ড, রানা প্লাজা ধস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনার সঙ্গে করোনা মহামারির পরও পোশাক খাতের ব্যবসা বেড়েছে ধারণার বাইরে। পত্রিকার রিপোর্টেই জানা যায়, ২০১৩ থেকে ২০২২ পর্যন্ত দশ বছরে প্রায় আড়াই গুণের কাছাকাছি। বিগত বছরের দশ মাসে পোশাক খাতে রপ্তানির পরিমাণ ৩ হাজার ৮৭৭ কোটি ডলার-যা বিগত বছরের তুলনায় পৌনে ৬ শতাংশ বেশি।
অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি ইইউ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও চাহিদার ঘাটতি শুরু হয়েছে করোনা মহামারির প্রভাবে। পরবর্তীতে রাশিয়া-ইঊক্রেন যুদ্ধের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা রকম নিষেধাজ্ঞার আলোচনায় পোশাকের ক্রয়াদেশ হ্রাসের ব্যপারটি দৃশ্যমান হতে থাকে। অথচ এটা জানলে অবাক হবেন যুক্তরাষ্ট্রের নানা রকম নিষেধাজ্ঞার পরও রাশিয়া বা তাদের পাশর্^বর্তী দেশগুলিতে আমাদের পোশাক রপ্তানি হয়েছে তৃতীয় দেশের (প্রতিবেশী ভারত বা পোল্যান্ড হয়ে) মাধ্যমে। বর্তমানে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইঊরোপীয় ইঊনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ শ্রমনীতিসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে জোরালোভাবে কথা বলার পিছনে আমাদের দেশের ভবিষ্যতের চেয়ে তাদের বিশ্ববিখ্যাত বিভিন্ন ব্র্যান্ড-ক্রেতাদের ভবিষ্যৎ ব্যবসা-পরিকল্পনা কেন্দ্রিক। কেননা আমাদের দেশের পোশাক রপ্তানি খাত থেকে বার্ষিক আয়ের পরিমাণের তুলনায় বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলির বার্ষিক টার্নওভার এর পরিমাণ কতো তাও ভেবে দেখা দরকার। প্রকৃত পক্ষে আমাদের দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতা চেয়ে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান তাদের দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক পরিকল্পনার স্বার্থে পণ্য সরবরাহের পথ কতোটুকু মসৃণ ও নিশ্চিত নিরাপদ থাকবে সেটাই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই এইসব বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলি নানা শর্তের কথা বলছে। অথচ আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বলতে দেখা যায় বিদেশি রাষ্ট্রে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা নাকি তাদের সরকারকে পাত্তাই দেয় না। কি বিচিত্র এই দেশ বিচিত্র সেলুকাস।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প নিয়ে আজকের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে পোশাক শ্রমিক সংগঠনের নেতা কল্পনা আক্তার এর ভাষ্য-“পোষাক শিল্পের মালিকেরা দ্বৈত ভূমিকায় রয়েছেন। তারা সরকারের অংশ, আবার তারা শিল্পেরও মালিক।” তার কথা শুনে মনে পড়ছে আমাদের দেশের রাজনীতি নিয়ে রসিকতা করার একটি মন্তব্য- “রাজনীতির মধ্যে পলিটিক্স ঢুকে গেছে।” প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশের ব্যবসার মধ্যে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে এবং রাজনীতির মধ্যে ব্যবসা ঢুকে গেছে। তাই রাজনীতি এবং ব্যবসার এক জটিল সিন্ডিকেটের কঠিন দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতে পোশাক খাতের বিরাজমান পরিস্থিতি। যদি তাই না হয় যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইঊনিয়নের নানা রকম শর্তাবলী ও শ্রমনীতি নিয়ে দেশের সবাই যখন চিন্তিত তখন পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট মালিকগণ সরাসরি বলেছেন চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমাদের রাজনীতি প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে পুলিশের সাবেক এক আইজি ও বিগত জাতীয় সংসদের সরকার দলীয় সদস্যের ভাষায় বলতে হয় “রাজনীতি আসলে নষ্ট-ভ্রষ্টদের হাতে বেশি, তাই চাইলেও কাজ করা কঠিন।” দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনের জন্য মনোনয়ন জমা প্রদান বিষয়ে তার এলাকার উদ্ভূত পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেছেন- (প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর সূত্রে) । তার এই কথা শুনে গুরুজনের একটি ঊক্তির কথা মনে পড়ে গেল-“চোখ আছে দেখে যা, কান আছে শুনে যা। দেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে পোশাক শিল্পের বেসামাল অবস্থাকে ঘিরে আলোচিত তর্ক-বির্তকের কারণে দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতির কারণে যাঁতাকলে নিষ্পেষিত জনগণের ভোগান্তির বিষয়টি চাপা পড়েছে অনেকটা নীরবেই। আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি প্রতিটি পোশাক কারখানার মালিক তাদের শ্রমিকদের বেতন নিয়মিত প্রদানের ব্যাপারটি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। এ কারণে প্রত্যেক কারখানা মালিক মাসের সাত থেকে দশ তারিখের মধ্যে পরিশোধের লক্ষ্যমাত্রা টার্গেটে নিয়ে বেতন প্রদান করে আসছে সেই করোনা মহামারির সময় থেকে। আগেই বলেছি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি ইইউ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও চাহিদার ঘাটতি শুরু হয়েছে করোনা মহামারির প্রভাবে। পরবর্তীতে রাশিয়া-ইঊক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা রকম নিষেধাজ্ঞায় আমাদের দেশে পোশাকের ক্রয়াদেশ হ্রাসের ব্যপারটি দৃশ্যমান হতে থাকে। এর সঙ্গে ডলার সংকট সার্বিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। সমস্যায় পড়লে মানুষ বলে থাকে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, আমার মতে দেয়ালে পিঠ ঠেকেনি, পিঠের সঙ্গে দেয়াল ঠেকে গেছে। অতএব স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতির পথ নিজেকেই খুঁজতে হবে।
পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট আমার বিগত কয়েক বছরের কর্ম অভিজ্ঞতার আলোকে এখানে ঢাকার একটি শিল্প গ্রুপের কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরছি। পোশাক খাতে গত দুই বছর ধরে ক্রমান্বয়ে রপ্তানি বা ক্রয়াদেশ যে কমতে ছিল তা স্পষ্ট হবে বছর-ওয়ারী এই বিশ্লেষণ থেকে। ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে সর্বমোট রপ্তানির পরিমাণ ৪ কোটি ৪৭ লাখ ৭৯ হাজার ডলার। যার মাসিক গড় পরিমাণ ৪৯ লাখ ৭৫ হাজার ডলার। অথচ ভয়াবহ করোনা মহামারির পরবর্তী বছর ২০২১ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭ কোটি ৭৯ লাখ ২৪ হাজার ডলার-যেখানে মাসিক গড় রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬৪ লাখ ৯৪ হাজার ডলার। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ৬২ লাখ ৯৬ হাজার ডলার রপ্তানির মধ্যদিয়ে বছর শুরু করে উঠা-নামার পরও ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ ৮৬ লাখ ৭৯ হাজার ডলার রপ্তানির মধ্যদিয়ে বছর শেষ করা গেছে। অথচ ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে ৬১ লাখ ৬১ হাজার ডলার রপ্তানির মধ্যদিয়ে বছর শুরু করার পর ফেব্রুয়ারিতে করা ৮০ লাখ ২৬ হাজার ডলার রপ্তানিই ছিল এই বছরের সর্বোচ্চ। ২০২৩ সালের পরবর্তী মাসগুলিতে উঠা-নামার মধ্যদিয়ে বিগত নভেম্বর মাসে করা রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ২৩ লাখ ২৯ হাজার ডলার, এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বর মাসে করা ১৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার ছিল এই বছরের সর্ব নিম্ন রপ্তানি। অথচ অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, ভয়াল করোনাকালীন পরবর্তী বছর ২০২১ সালের মে মাসে করা ৪৭ লাখ ৯৪ হাজার ডলার রপ্তানি ছিল সেই বছরের সর্বনিম্ন । মে মাস ছাড়া ওই বছরের কোনো মাসের রপ্তানির পরিমাণ ৫৫ লাখ ডলারের নিচে আসেনি।
এবার আসি ২০২২ সালের বিশ্লেষণ নিয়ে। ৯৬ লাখ ৬৮ হাজার ডলার মূল্যের শিপমেন্ট দিয়ে বছর শুরু করা ডিসেম্বর মাসের রপ্তানি ঠেকে যায় ৩৯ লাখ ৮৬ হাজার ডলারে যা ওই বছরের সর্বনিম্ন। ২০২২ সালে সর্বমোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮ কোটি ৭৪ লাখ ৮৭ হাজার ডলার যার মাসিক গড় পরিমাণ ৭২ লাখ ৯৩ হাজার ডলার। বিশ্লেষণের এই পর্যায়ে বিগত তিন বছরে পাঁচটি কারখানা থেকে ইনভয়েসের বিপরীতে বছর ওয়ারী রপ্তানিকৃত মোট পোশাক সংখ্যার আনুপাতিক হিসাবের পরিসংখ্যান উল্লেখ করলে পরিষ্কার হবে মজুরি বাবদ পোশাক প্রতি আয়ের পরিমাণ কতো? ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত রপ্তানি করা পোশাকের গড় মূল্য পড়েছে ৩.৭৩ ডলার। ২০২২ সালে রপ্তানিকৃত মোট পোশাক সংখ্যার হিসাবে গড় মজুরি আয় ছিল ৪.০৬ ডলার এবং ২০২১ সালে এর পরিমাণ ৪.০৫ ডলার। অতএব বুঝতে বাকি নেই হঠাৎ করে রপ্তানি আয় কমে গেছে তা ঠিক নয়। বরং আংশিক হলেও সত্যি যে, করোনা পরবর্তী বছর থেকে পোশাক খাতে এই ধাক্কা শুরু হয়ে আজকের এই নাজুক পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলার সংকটের লড়াই। গ্রুপের পাঁচটি কারখানার কর্ম সক্ষমতার বিপরীতে মাসিক রপ্তানির পরিমাণ নিয়ে কখনো-কখনো মালিক পক্ষসহ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অসন্তুষ্টি থাকলেও আমার দেখা তিন বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ১ কোটি ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ডলার রপ্তানি যা সম্ভবত এই গ্রুপের সর্বোচ্চ রেকর্ড। এর পরবর্তী মাস থেকে ক্রমান্বয়ে শুরু হয় রপ্তানির ঘাটতি-যেখানে একবার (আগস্ট মাসে) ৮৬ লাখ ২৩ হাজার ডলারে উঠলেও আর সুদিন ফিরে আসেনি। বলাবাহুল্য এই কঠিন সময়েও গ্রুপের সব কারখানার শ্রমিকসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-বোনাসসহ সকল প্রকার আর্থিক সুবিধা প্রাপ্তির ব্যাঘাত ঘটেনি কোম্পানির আর্থিক সচ্ছলতার পাশাপাশি মালিক পক্ষের সক্ষমতা ও আন্তরিকতার কারণেই- যা অবশ্যই প্রশংসনীয়। এর বিপরীতে বর্তমান প্রেক্ষাপটে কী অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। কেননা, আমার জানামতে গ্রুপের সকল শ্রমিক-কর্মকর্তা/কর্মচারীর মাসিক বেতন পরিশোধের জন্য প্রয়োজন হতো প্রায় ১৫/১৬ কোটি টাকা। এই অংকের বেতন পরিশোধের জন্য দরকার ছিল কম করে হলেও মাসিক ৮/৯ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি। ক্রমাগত রপ্তানি আয় হ্রাস পেতে থাকলেও বেতন ভাতা পরিশোধের বিষয়টি মালিক পক্ষের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল হাতে জমা থাকা অতীত লভাংশের নির্ভরতায়। অতএব আজকের এই নাজুক পরিস্থিতি ও কঠিন বাস্তবতায় প্রকৃত অবস্থা কী তা খুলে বলা নিষ্প্রয়োজন।
পোশাক শিল্প খাতের মালিক-শ্রমিক-পেশাজীবীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর মেধার সমন্বয়ে বিশ্ব দরবারে আমাদের দেশের অবস্থান কোথায় পৌঁছে গেছে তা সাধারণ জনগণ না জানলেও যারা বিদেশ ভ্রমণের সময় পোশাক ক্রয় করেছেন বা বিশ্ব বিখ্যাত বিভিন্ন শপিং মলে ঘুরেছেন তাদের বুঝতে বাকি নেই। এর পিছনে শ্রমিক-কর্মচারীদের কী পরিমাণ অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সময় ব্যয় করতে হয় তা আমি বুঝতে পেরেছি দীর্ঘ সময়ের পেশা বদল করে পোশাক খাতের সঙ্গে জড়িত হয়ে ৩/৪ বছরের কর্ম-অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে। তাই আমার লেখা শেষ করার আগে একটি ঘটনা উল্লেখ না করে পারছিনা। বিগত জুলাই মাসের প্রথম দিকে মালয়েশিয়ায় গিয়ে কুয়ালালামপুর ও পেনাং শহরের বড় বড় শপিং মল ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। কুয়ালালামপুরে অবস্থিত বিশে^র সপ্তম বৃহৎ শপিং মল “ওয়ান উতামা”-য় বিশ্ববিখ্যাত বিভিন্ন ব্র্যান্ড শপগুলিতে “ মেইড ইন বাংলাদেশ” ট্যাগ ঝুলানো পোশাক ঝুলে থাকতে দেখেছি আপন মর্যাদায়। এমনি একটি ব্র্যান্ড শপ থেকে কয়েকটি পোশাক পছন্দ করে বিল পরিশোধ করার সময় টি-শার্টের গায়ে দেখতে পেলাম “মেইড ইন বাংলাদেশ” ট্যাগ। গায়ে লাগানো স্টিকারে লেখা ১৭৯ রিঙ্গিত এর উপর ডিসকাউন্ট দিয়ে ১১৯ রিঙ্গিত পরিশাধ করতে হয়েছে বাংলাদেশি মূদ্রায় যার পরিমাণ ছিল ৩১৬৫/- টাকা। এর পাশাপাশি বিগত এপ্রিল মাসে কলকাতা ভ্রমণের সময় সেখানকার একটি বৃহৎ শপিং মলের বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ড “বস” এর স্টোরে একটি টি-শার্টের স্টিকারে ভারতীয় মূদ্রায় ১১,০০০ (এগার হাজার) রুপি মূল্য দেখে রীতিমতো বিস্মিত না হয়ে পারিনি-কেননা প্রথমে ভেবেছিলাম ১১০০/রুপি।