বলা হয়ে থাকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) দেয়ালও কথা বলে। দেশের পূর্ণাঙ্গ আবাসিক এ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল ইটের দালানগুলোর দেয়ালে শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি তুলে ধরে, কোথাও আবার শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আওয়াজ। সম্প্রতি এ দেয়ালচিত্র নিয়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ধর্ষণ ও এর প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মধ্যে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি মুছে একটি ভবনের দেয়ালে ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যাঙ্গাত্মক’ গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। গ্রাফিতিতে লেখা রয়েছে, ‘ধর্ষণ ও স্বৈরাচার থেকে আজাদী’।
আর এ অভিযোগ করা হয়েছে ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের বিরুদ্ধে। অভিযোগের পর জাবি ছাত্র ইউনিয়নের শীর্ষ দুই নেতাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের বিশেষ সভায় জাবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি অমর্ত্য রায় ও সাধারণ সম্পাদক ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলীকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইনে মামলারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাফিতি আঁকার কারণে একেবারে বহিষ্কার করার অর্থ হলা দেয়ালকেও ভয় পাচ্ছে স্বৈরাচারি শাসন ব্যবস্থা। ওই দেয়ালারের সামনেই রয়েছে বঙ্গবন্ধুর আরেকটি ছবি। তারা বলছেন, সব দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর ছবি কেন থাকতে হবে আর অন্যের দেয়াল দখল করে তাকে কেন বিতর্কিত করতে হবে?
মূলত, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনের একটি দেয়ালে ব্যাঙ্গাত্মক গ্রাফিতি আঁকা হয়। যখন ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশের পক্ষ থেকে ছাত্র ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি মুছে ফেলার অভিযোগ আনা হয়, তখন তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্র ইউনিয়ন একটি ব্যাখা দেয়।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্র ইউনিয়ন জানায়, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে নতুন কলা ভবনের দেয়ালে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষয়ে যাওয়া একটি প্রতিকৃতি মুছে ধর্ষণবিরোধী গ্রাফিতি আঁকার কারণে ছাত্র ইউনিয়নের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যে বক্তব্য রাখছে বিভিন্ন মহল, তা অত্যন্ত স্বার্থান্বেষী এবং ক্যাম্পাসে চলমান আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করারই নামান্তর।
এ ব্যাপারে জাবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি অমর্ত্য রায় বলেন, ‘আমাদের বহিষ্কারাদেশের মূল কারণ আসলে পুরনো; দেয়ালচিত্র মুছে ধর্ষণবিরোধী গ্রাফিতি আঁকার কারণে না। অভ্যন্তরীণ শিক্ষক রাজনীতি, মাস্টারপ্ল্যানের আন্দোলন এবং উন্নয়ন প্রকল্পের ৩১০ কোটি টাকা এখানে বড় ফ্যাক্টর।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই দেয়ালে আগেও ছাত্র ইউনিয়নের দুর্নীতিবিরোধী গ্রাফিতি ছিল। যেটা মুছে ছাত্রলীগের দুই নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি প্রতিকৃতি আঁকান। ছাত্র ইউনিয়ন নেতাকর্মীরা বলছেন, তাদের না জানিয়েই আগের চিত্রকর্ম মুখে ওই দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর চিত্রকর্ম আঁকা হয়। এ ছাড়া একই দেয়ালের পাশে বঙ্গবন্ধুর আরেকটি প্রতিকৃতি রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে ছাত্র ইউনিয়নের দুই নেতাকে বহিষ্কারের ঘটনায় নানা পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে।
জাবির সাবেক শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু অলিখিত বিষয় থাকে। যে বিষয়গুলো শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানেন। যেমন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দেয়ালে গ্রাফিতি বা দেয়াল লিখন করার দায়ে অমর্ত্য ও ঋদ্ধ এক বছরের জন্য বহিষ্কৃত হয়েছেন, সেই দেয়ালটি বরাবরই ছাত্র ইউনিয়নের জন্য বরাদ্দ ছিল। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন দেখতাম, প্রতি বছর কাউন্সিলের আগে ছাত্র ইউনিয়ন দেয়ালটি নতুন করে সাজাত। আমাদের আগে বহু বছর ধরে ছাত্র ইউনিয়ন এ কাজটি করে এসেছে। আমাদের পরেও বহু বছর ধরে ওই দেয়ালের ছাত্র ইউনিয়নই এঁকেছে। এই দফা আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সবকিছুই দখল করে নিয়েছে। দেয়ালটি বাকি থাকার কথা নয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মৃধা মো. শিবলী নোমান মনে করেন, ক্যাম্পাসে চলমান ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকে উপলক্ষ্য করে বিভিন্ন ঘটনা যেভাবে ডালপালা মেলেছে এবং আন্দোলনের গতি-প্রকৃতিকে নিত্য পরিবর্তন করেছে, তার ভেতর গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনের বাইরের দেয়ালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়ালচিত্র মুছে তার ওপর আন্দোলনরত একটি ছাত্র সংগঠনের ধর্ষণবিরোধী দেয়ালচিত্র অঙ্কন।
নিজের ওয়েবসাইটে এক প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, খুব স্বাভাবিকভাবেই এহেন আচরণকে অনেকেই ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন তথা ছাত্রলীগের প্রতি উসকানিমূলক আচরণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, আপাত বিবেচনায় যা মোটেই অসত্য নয়। আবার শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি বড় অংশ বঙ্গবন্ধুর চিত্র মুছে ফেলার বিষয়টিকে জাতির জনকের অবমাননা হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন। তবে পুরো বিষয়টিতে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছুটা স্মৃতিভ্রষ্টতাকে লালন করা হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়।
এই শিক্ষক বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনের যে স্থানে উক্ত দেয়ালচিত্রটি ছিল, স্মৃতি ঘাটলে দেখা যাবে ২০১৯ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে চলমান আন্দোলনের সময় ঠিক সেই স্থানে দিনের আলোতে একটি ক্যারিকেচার এঁকেছিলেন সেই সময়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। সেই ক্যারিকেচারটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়ের বাস্তবতায় নানাভাবে প্রাসঙ্গিক ছিল না, বরং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত এক যুগের শিক্ষক রাজনীতির সিলসিলার এক দারুণ রূপায়নও ছিল। তবে সেই সময়ের আন্দোলনটি কিছুটা থিতু হওয়ার খুব অল্প সময়ের ভেতর মুজিব শতবর্ষকে উপলক্ষ্য করে সেই ক্যারিকেচারটির ওপর হঠাৎ করেই বঙ্গবন্ধুর ছবিসম্বলিত দেয়ালচিত্রটি আঁকা হয়েছিল, যার ফলে আগের ক্যারিকেচারটিকে লোকচক্ষুর আড়ালে নেয়ার কোন উদ্দেশ্য ছিল কিনা, সেই প্রশ্ন সামনে আসতে পারে।
নিজ স্বার্থরক্ষায় ভিন্নমত দমনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকে একটি সস্তা মাধ্যমে পরিণত করার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করা প্রয়োজন উল্লেখ করে শিবলী নোমান বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনেই বঙ্গবন্ধুর আরেকটি বিশাল দেয়ালচিত্র আঁকা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে। আর এটিও স্বীকার করতেই হয় যে এই ছবিটি খুব দৃষ্টিনন্দন হয়েছে। এই ছবিটির নিচে এর আগে যে দেয়ালচিত্র ছিল তাতে দেখানো হয়েছিল কীভাবে কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় নামক যন্ত্রে প্রবেশ করে ‘সহমত ভাই’ বলতে উচ্চকিত একটি যান্ত্রিক শ্রেণিতে পরিণত হয়। সেই দেয়ালচিত্রের ঠিক নিচেই ছিল ২০১৭ সালে অপর এক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের কাঁঠাল ও গাছের ডাল দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগের এক ব্যাঙ্গাত্মক দেয়ালচিত্র। এর ওপরে ছিল ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন হওয়া জুবায়ের আহমেদের হত্যাকারীদের বিচারের দাবির দেয়ালচিত্র, নিহত জুবায়ের আহমেদের ছবিসমেত।
নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মানস চৌধুরী বলেছেন, প্রশাসন এই বুদ্ধিমত্তা অবশ্যই দেখিয়েছেন যে ছবি আঁকার কারণে নয়, বরং আগের ছবিটা ‘মোছার’ জন্য শাস্তি দিয়েছেন। বলাই বাহুল্য আগের ছবিটা জাতির পিতার। এবং তার আরও বিশাল একটা ছবি রয়েছেই পাশে। এই দেয়ালে গত ৮ বছরে কম করেও চারটা ছবি ছিল। কিছু পুরান হলে অন্য ছবি আঁকা হয়। তার মধ্যে এমন ছবিও রয়েছে যা তখনকার প্রশাসন একটুও দেখতে চান নাই; এবং এখনকার প্রশাসন দেখলে কেউ কেউ মুখ টিপে হাসবেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিয়মকানুন না মেনে মহা তৎপরতায় দুজন নিয়মিত ছাত্র অমর্ত্য ও ঋদ্ধকে বহিষ্কার করেছে- দখলকৃত দেয়াল উদ্ধার করে ‘ধর্ষক ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে’ দেয়ালচিত্র আঁকার জন্য! এখানেই শেষ নয়, প্রশাসন উদ্যোগী হয়ে এই ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। প্রশাসনের এত উৎসাহ আর কর্মতৎপরতা ধর্ষক, হল দখলদার, চাঁদাবাজ আর সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কখনোই দেখা যায়নি। মাস্তান আর মেরুদণ্ডহীনদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না।
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম জানিয়েছেন, বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিন্ডিকেট। এ ক্ষেত্রে তার একার কিছু করার নেই।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৩ ফেব্রুয়ারি ধর্ষণের ঘটনার পর ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন-কর্মসূচি চলেছে, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন পৃথক কর্মসূচি করেছে। তবে সবচেয়ে বেশি কর্মসূচি দেখা গেছে নিপীড়ন বিরোধী মঞ্চের ব্যানারে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের একটি অংশের এই মঞ্চ গত ১৯ ফেব্রুয়ারিও মশাল মিছিল করেছে।
নিপীড়ন বিরোধী মঞ্চের দাবি ছিল পাঁচটি। সেগুলো হলো- ধর্ষক ও তার সহায়তাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা, মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে গণরুম বিলুপ্তপূর্বক নিয়মিত শিক্ষার্থীদের আবাসন নিশ্চিত করা ও র্যাগিং সংস্কৃতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা, সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জনির বিচার নিষ্পত্তি করা এবং যৌন নিপীড়ন সেলে উত্থাপিত সকল অমিমাংসিত অভিযোগসহ ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনা, নিপীড়কদের সহায়তাকারী প্রক্টর ও মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রভোস্টের অপরাধ তদন্ত করা ও সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাদেরকে তদন্ত চলাকালে প্রশাসনিক পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান, মাদকের সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে জড়িতদের ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণাপূর্বক তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
তবে অন্য দাবিগুলো বাস্তবায়ন না হলেও ২০ ফেব্রুয়ারির সিন্ডিকেট সভায় মাহমুদুর রহমান জনির বিচার হওয়ার পর তাদের আর কোনো কর্মসূচি দেখা যায়নি।
তবে ফেসবুকে এ সংক্রান্ত একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে নিপীড়ন বিরোধী মঞ্চ। সেখানে বলা হয়েছে, আমাদের পাঁচটি দাবি। প্রথমত, ধর্ষক ও তাদের সহযোগীরা সকলেই গ্রেপ্তার হয়েছে, আশা করি তারা সর্বোচ্চ শাস্তি পাবে। দ্বিতীয়ত, নিপীড়ক শিক্ষক জনিকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়েছে। অর্থাৎ, আমাদের দাবিগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং আমাদের সবগুলো দাবিই বাস্তবায়িত হবে। আপনারা যারা আমাদের সাথে আছেন, সংহতি জানাচ্ছেন তাদের সকলকে ধন্যবাদ। আমাদের সবগুলো দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সাথে থাকুন, নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ার আন্দোলনে সামিল হোন।
News Credit: বাংলা আউটলুক