তিস্তায় চীনা প্রকল্প‌ হ‌লে ভার‌তের ঝুঁকি কী কী

0
45

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘বাংলাদেশ ভারতের নেতৃস্থানীয় উন্নয়ন অংশীদার। একই সঙ্গে এই অঞ্চলে ভারতের বৃহত্তম ব্যবসায় অংশীদার।’ এই বিবৃতির আগে তাদের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা বৃহস্পতিবার (৯ মে) বাংলাদেশে দুই দিনের সফর শেষ করেন। সফরকালে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।

বিবৃতি অনুযায়ী, কোয়াত্রা বাংলাদেশ সরকারকালে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনার ভারত সফরের ভিত্তি প্রস্তুত করা।

চলতি বছর জানুয়ারিতে বাংলাদেশে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তিস্তা প্রকল্প পেছনে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠনের পর চীন এই প্রকল্পে ভূমিকা রাখার জন্য জোরালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।

তিস্তা প্রকল্প চীনের হাতে গেলে ভারতের কী ক্ষতি

ভারতের মাথাব্যথার প্রধান কারণ হলো চীন এখানে গেড়ে বসতে পারে এবং এটি পরবর্তীতে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হতে পারে। যেহেতু প্রকল্পটি ভারতের একেবারে ঘাড়ের কাছে। ভারতের শিলিগুড়ি করিডোরের কাছে। এই করিডোরকে ‘মুরগির ঘাড়’ বলা হয়ে থাকে। তিস্তা প্রকল্পে গেড়ে বসতে পারলে চীন হয়ত সহজেই ‘মুরগির ঘাড়’ জব্দ করে ফেলবে। তাহলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলো! সেটা হয়ত শুধুই কল্পনা। তবু ভারত হয়ত এ কারণেই হঠাৎ করে এ প্রকল্পে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রাক্তন ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী ভারতের একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ভারতের আপত্তির মাত্রা নির্ভর করবে পরিকল্পিত প্রকল্পটি এই অঞ্চলে চীনের অনুপ্রবেশকে কতটা অনুমতি দেবে তার উপর। ‘আমি মনে করি এই প্রকল্পে কাজ করার জন্য বাংলাদেশে কতজন চীনা শ্রমিক মোতায়েন করবে তা জানা গুরুত্বপূর্ণ,’ বলছেন পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। ‘প্রকল্পটিতে চীন শুধু বেসামরিক লোকজন নয়, শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে চীন সেখানে তাদের অনেক প্রাক্তন সেনাকর্মীদের ব্যবহার করতে পারে। কারণ তারা একটা কৌশলগত সুযোগ খুঁজছে। তারা শিলিগুড়ি করিডোরের কাছাকাছি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে চাইবে।’

তদুপরি, গত বছরের মে মাস থেকে মেইতেই ও কুকি-জো সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত সংঘর্ষের কারণে মণিপুর রাজ্য এখনও অস্থিতিশীল।

এই উদ্বেগ ছাড়াও, চীনা কর্মকর্তারা ভারত ও বাংলাদেশের অনেক সংবেদনশীল তথ্য যা ভারতের নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে তা ব্যবহারের সুযোগ পেতে পারে।

২০২৩ সালে ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরের সময় শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তিস্তা এলাকার প্রকল্প সম্পর্কে ভারত সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করা বাংলাদেশের জন্য আবশ্যক নয়।

গত বছর ডিসেম্বর বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনও প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন, বেইজিং তিস্তা অববাহিকা উন্নয়নের প্রস্তাব পেয়েছে। একই মাসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র স্বীকার করেছিলেন যে, প্রকল্পটি কাকে দেওয়া হবে তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকার ভূরাজনৈতিক বিষয়গুলো বিবেচনা করবে।

‘যদিও চীনের প্রস্তাব গ্রহণের আগে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করার প্রতিশ্রুতি ভারতকে আশ্বস্ত করে, দীর্ঘদিনের তিস্তা সমস্যা সমাধানের আগে নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তা করে দেখতে হবে,’ বলছেন ভারতের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সহযোগী ফেলো এবং বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ সোহিনী বোস।

তিস্তার পানি: ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিরোধের একটি প্রধান ইস্যু

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর থেকেই তিস্তা নিয়ে নয়াদিল্লি ও ঢাকার মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। তিস্তা বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী। তিস্তার পানি নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, দিনাজপুর ও বগুড়ার প্রায় এক কোটি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। তিস্তার পানি দিয়ে বাংলাদেশের প্রায় ১৪ শতাংশ ফসল উৎপাদন হয়।

বাংলাদেশ প্রতিদিন অভিযোগ করছে যে, ভারত বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার পানি অন্যায্যভাবে তুলে নিচ্ছে।

অন্যদিকে ভারতীয় সংবিধান অনুসারে নদীগুলো রাজ্য সরকারের অধীন। তাই তিস্তা নিয়ে কোনো চুক্তি করতে হলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুমতি দরকার। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তিস্তার পানি দিতে নারাজ।

তিস্তার মোট দৈর্ঘ্য ৪১৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ১২১ কিলোমিটার।

তিস্তা প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ কি কূটনৈতিক খেলা খেলছে

গত ১৩ বছর ধরে বিজেপি সরকারের প্রতিশ্রুতির পর তিস্তার পানি বন্টন চুক্তির অগ্রগতি হয়নি। সুতরাং নয়াদিল্লির ওপর ক্রমবর্ধমানভাবে অধৈর্য হয়ে ঢাকা বেইজিংকে প্রকল্পটি দিতে পারে এমন ধারণা করলে অত্যুক্তি হবে না।

তবু, দুই দেশের সম্পর্কে কিছু তিক্ততা থাকলেও, বাংলাদেশ বছরের পর বছর ধরে ভারতের ‘প্রতিবেশী আগে’ নীতির সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী হিসাবে পরিচিত। তাদের তার প্রতিবেশী দেশকে বিচ্ছিন্ন করার সামর্থ্য নেই।

ভারতের পক্ষে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বিদ্রোহী-বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে বারবার কাজ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। যা করেনি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি। বরং তাদের বিরুদ্ধে কট্টর ইসলামপন্থীদের লালন-পালনের অভিযোগ রয়েছে যারা ভারতের অনেক নীতির সমালোচক এবং মোদি সরকারকে মুসলমানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য অভিযুক্ত করে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিস্তা প্রকল্প চীনের সামনে ঝুলিয়ে রাখা এবং ভারতকে সেটা অনুধাবন করানো বাংলাদেশের একটি কূটনৈতিক খেলা হতে পারে।

পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলছেন, ‘বাংলাদেশ ভারতকে জানাচ্ছে যে, তাদের কাছে বিকল্প আছে। তারা চাইলেই যেকোনো সময় চীনের কাছে যেতে পারে। ঢাকা এর আগেও বেশ কয়েকবার এমন করেছে। ভারসাম্য রক্ষার নীতি থেকে সুবিধা আদায়ের জন্য দুটি বড় শক্তি একে অপরের বিরুদ্ধে খেলছে।’

(দ্য কুইন্ট ডট কম থেকে অনুবাদ)

সুত্রঃ বাংলা আউটলুক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here