একদফা দাবিতে গত ২৮ অক্টোবরের পর লাগাতার হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি শুরু করে বিএনপিসহ মিত্ররা। শুরুতে কর্মসূচির প্রভাব থাকলেও ধীরে ধীরে তা কমতে থাকে। আন্দোলনের কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তুলতে পারছে না বিএনপি ও তার মিত্ররা। এ অবস্থায় এক মাসের বেশি সময় ধরে চলমান কর্মসূচির বিকল্প খুঁজছেন নীতিনির্ধারকরা। সেইসঙ্গে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে একদফা আন্দোলনের গতি বাড়াতে চায় বিএনপি। তপশিল মোতাবেক দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর এক মাস। নির্বাচনে অংশ নিতে সার্বিক প্রস্তুতি প্রায় শেষ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ অনেক দল। অন্যদিকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে সরকারের পদত্যাগ ও একদফা নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে যুগপৎভাবে লাগাতার আন্দোলন করছে বিএনপিসহ ৩৯টি রাজনৈতিক দল এবং সমমনা জোট। পৃথকভাবে ধারাবাহিক কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে সক্রিয় আছে জামায়াতে ইসলামী এবং চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, আগামী দিনের কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নির্বাচন বয়কট করা সব দলকে নিয়ে একযোগে মাঠে নামতে চায় বিএনপির হাইকমান্ড। এক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকে বিশেষভাবে পাশে চায় দলটি। কেননা ভোট এবং আন্দোলনের বিচারে এ দুটি দলের রয়েছে বিপুল জনশক্তি। ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকাতে জামায়াতকে নিয়ে যেমন কঠোর আন্দোলন করা হয়েছিল, এবারও তেমনই লক্ষ্য বিএনপির। নিবন্ধিত দল হয়েও আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছে ইসলামী আন্দোলন। সেইসঙ্গে দলীয় সরকার নয়, জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপিসহ বিরোধীদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছে দলটি। ফলে এসব দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা একাধিক ভার্চুয়াল বৈঠক করেছেন এবং যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। সেইসঙ্গে নির্বাচন বয়কট করা অন্যান্য রাজনৈতিক দলকেও একই মঞ্চে আনার লক্ষ্য বিএনপির। মূলত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দ হলে এই সময়ের মধ্যে সব দলের মধ্যে সমঝোতাও হবে এবং একটি অভিন্ন লক্ষ্যে আন্দোলনের রূপরেখার ঘোষণা আসতে পারে। এককথায়, চলতি মাসেই আন্দোলনের গতি আরও বাড়বে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, চলমান সরকারবিরোধী একদফার আন্দোলনকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে সম্প্রতি জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির হাইকমান্ডের একাধিকবার যোগাযোগ হয়েছে। পাশাপাশি নির্বাচন বয়কট করে সরকারবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত যুগপতের বাইরের একাধিক দল ও জোটের সঙ্গেও বিএনপির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হচ্ছে। আন্দোলনকে আরও গতিশীল করতে সরকারবিরোধী প্রায় সব দল ও জোটকে ভোটের আগে একই মঞ্চে আনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বর্তমান দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড়। নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত মিলিয়ে ৬৪টি রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করেছে। আসন্ন নির্বাচন ঠেকানোর কৌশল নিয়ে গত ২৮ নভেম্বর ৩৯টি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। সেখানেও প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান। তার মতে রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা থাকলেও বৃহত্তর স্বার্থে জাতীয় ইস্যুতে এসব দলও ঐক্যবদ্ধ থাকবে।
সরকারবিরোধী দলগুলোকে একই মঞ্চে আনতে বিএনপির তৎপরতা সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে। গত ২৮ নভেম্বর ঢাকায় দেশের বিদ্যমান সংকটময় পরিস্থিতিতে বিভিন্ন পেশাজীবী প্রতিনিধিদের সঙ্গে জাতীয় সংলাপের আয়োজন করেন চরমোনাই পীর। সেখানে সরকার পতনের আন্দোলনে ঐক্যের আহ্বান নিয়ে এক টেবিলে বসেন বিএনপি এবং দেশের ডানপন্থি ও বামধারার কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন, সরকার পতন ও রাষ্ট্র মেরামতে জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে একমত পোষণ করেন। জামায়াতের একজন প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন, জুলুম আজ বাম-ডান সবাইকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে। মজলুমদের ঐক্য হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বস্ত নেতৃত্ব চায়, এ দায়িত্ব নিতে হবে।
নির্বাচনবিরোধী একাধিক দলের নীতিনির্ধারকরা জানান, নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর ৭ জানুয়ারির ভোট ঘিরে নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে চান তারা। এক্ষেত্রে বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে একসঙ্গে শক্তভাবে কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। এ বিষয়ে যুগপতের শরিকরা যেন আপত্তি না করেন, তা নিয়ে শরিকদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। জামায়াত গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে প্রথম দুটি কর্মসূচি যুগপৎভাবে পালন করলেও বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের পর নিজস্ব আঙ্গিকে এককভাবে কর্মসূচি পালন করছে। সর্বশেষ গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার আরামবাগে মহাসমাবেশ করেছে দলটি। অবশ্য সেদিন নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সহিংসতায় তা পণ্ড হয়ে যায়। অন্যদিকে জামায়াত শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ শেষ করায় দলটির ভোটে যাওয়া নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত জামায়াত আর নির্বাচনে যায়নি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ তাহের বলেন, আমরা ৭ জানুয়ারির আগেই আশা করি বিএনপিসহ সব বিরোধী দল এক ব্যানারে-এক মঞ্চে আন্দোলনের মোহনায় মিলিত হবো। সম্মিলিত আন্দোলনের মাধ্যমেই এই সরকারের পতন নিশ্চিত হবে। অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা কবে?–এমন প্রশ্নের জবাব তিনি বলেন, আগে সবাই এক কাতারে শামিল হচ্ছি, তারপর সবাই মিলে ক্রমান্বয়ে সম্মিলিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম কালবেলাকে বলেন, দেশবাসী জামায়াতে ইসলামীকে তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল মনে করে। জালিম সরকার বিরোধী দলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে নির্বাচনের নামে প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করতে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের পদত্যাগের দাবিতে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করছে। শুধু তাই নয়, এসব দল বর্তমান দলীয় সরকারের অধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিলও বয়কট করেছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশ বারবার সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছে। সুতরাং বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে কীভাবে?
এদিকে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকলেও কোনো কঠোর কথা বলছে না চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটি মাঝে মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু দাবিতে কর্মসূচি দিলেও নির্বাচন নিয়ে তাদের খুব বেশি কঠোর দলীয় বার্তা নেই। তবে দলটি নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছে। গত ৩ নভেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করে দলটি। সেখানে সারা দেশের নেতাকর্মীরা ‘নির্বিঘ্নে’ জমায়েত হয়েছিলেন। ঘটনার পরও রাজনৈতিক মহলে নানা কথা চাউর হয়।
এর আগে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী ও দলটির সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এর পরই দলটি বরিশালসহ সিলেট, রাজশাহী ও খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন বর্জন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়। চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমসহ একাধিক নেতা বারবার বলেছেন, ২০১৪ আর ১৮ সালের মতো সাজানো নির্বাচন এ দেশে আর হতে দেওয়া হবে না।
নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপির একদফার আন্দোলনে সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন গতকাল মঙ্গলবার কালবেলাকে বলেন, আমাদের দফা এক দাবি এক এবং এ বিষয়ে সবাই ঐকমত্য। সম্মিলিতভাবেই সরকারের পদত্যাগ চাই, যারা দলীয় সরকারের অধীনে ভোট বর্জন করেছে তাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করে যাব।
আশরাফ আলী আকন বলেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে কতটা অন্তঃসারশূন্য এবং দেউলিয়া যে, বিএনপির নেতা শাহজাহান ওমরকে নৌকার প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হলো। অথচ শাহজাহান ওমর যেই মামলার আসামি হয়ে ছাড়া পেল একই মামলার অন্য আসামিরা এখনো কারাগারে বন্দি। সুতরাং একটি বিষয় প্রমাণিত যে, বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রায় সব মামলা মিথ্যা ও বানোয়াট।