“জয়বাংলা” শ্লোগান দিয়ে দখলদাররা দখল করতে চাইছে গ্রামীন টেলিকম, গ্রামীন ব্যাংকসহ শান্তিতে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. ইউনূসের ৮টি প্রতিষ্ঠান। ১২ ফেব্রুয়ারী থেকে শুরু করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সরব পাহাড়ায় চলছে দখল প্রক্রিয়া। রাজধানী ঢাকার মীরপুর চিড়িয়াখানা সড়কে অবস্থিত ইউনূস সেন্টারের আশপাশের বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে, ক্ষমাতাসীনদের ভয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন তারা।
শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। গ্রামীন টেলিকম, ইউনূস সেন্টারসহ সবগুলো প্রতিষ্ঠানই বন্ধ ছিল। আর ১২ নভেম্বর বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে যারা প্রায় প্রতিদিনই মহড়া দিয়েছে; তারাও ছিলেন না। তবে, আশপাশের বাসিন্দা এবং ব্যবসায়ীদের পাওয়া গেল।
রাইনখোলা সড়কের মোড় পেড়িয়ে ইউনূস সেন্টারের কাছাকাছি একজন ব্যবসায়ীর সাথে কথা হয় বাংলা আউটলুকের। নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশ করা গেল না। কারণ ইউনূস সেন্টারের আশপাশে যারা দখল প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে আসেন তাদের অধিকাংশই স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্বে আছেন।
ওই ব্যবসায়ী জানালেন, ১২ তারিখ বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে হঠাৎ ১৫ থেকে ২০ জন অজ্ঞাত লোক টেলিকম ভবনে প্রবেশ করতে চান। ইউনূস সেন্টারের স্টাফরা তাদের পরিচয় জানতে চান। কিন্তু স্টাফদের বাঁধা উপেক্ষা করেন; এবং এদের মধ্যে কর্ণেল রাশেদ যিনি গ্রামীন ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়ে গ্রামীন কল্যাণ ও গ্রামীন টেলিকম অফিসে যাবেন জানান। নিরাপত্তা চৌকি ডিঙ্গিয়ে সরসরি বিকেল ৪টা ৩৪ মিনিটে অফিস কক্ষে প্রবেশ করেন।
এসময় গ্রামীন কল্যাণে দায়িত্বরত একজন বাংলা আউটলুককে জানান, অফিস কক্ষে প্রবেশ করেই তারা বিভিন্ন অফিস স্টাফদের পরিচয়পত্র চেক করেন। অফিস স্টাফদের অফিসের সময় পেরিয়ে গেলেও বাইরে যেতে বাঁধা দেয়া হয়। এসময় ওই দুই প্রতিষ্ঠানের কর্মরতদেরকে অকথ্য ভাষায় গালাগালও করেন বলে অভিযোগ করেন ওই কর্মী। কর্ণেল রাশেদের নেতৃত্বে অবৈধ ভাবে প্রবেশকারীরা রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত কল্যাণ ও টেলিকম অফিসে অবস্থান করেন।
এর আগে সন্ধ্যার পর পরই কর্ণেল রাশেদের নেতৃত্বে আসা ওই ব্যাক্তিরা গ্রামীন টেলিকম ও গ্রামীন কল্যাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কক্ষে গিয়ে আলাদা ভাবে মিটিং করেন। পরে সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে দখলদাররা তাদের দুইজন প্রতিনিধি রেখে বাইরে চলে যান। এবং বলে যান, এই দুই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন হয়েছে, সেই অফিস আদেশ নিয়ে তাদের একজন প্রতিনিধি আসছেন, যিনি পথে আছেন। এর পর রাত ৯টা ১০ মিনিটে অফিসের গেইটে তালা লাগিয়ে অজ্ঞাত ওই ব্যাক্তিরা চলে যান। এবং বলে যান, পর দিন ১৩ ফেব্রুয়ারী সকাল ১০টায় অফিস খোলা হবে।
পর দিন ১৩ ফেব্রুয়ারী সকালে ওই ব্যাক্তিদের ১৮-২০ জন প্রতিনিধি এসে তালা খুলে দেয়। কিন্তু তারা অফিসে প্রবেশ না করে ইউনূস সেন্টারের আশপাশে অবস্থান নেয়। ওই দিন তারা গ্রামীন কল্যণ ও টেলিকম থেকে প্রফেসর ড. ইউনূসকে অপসারণ করা হয়েছে এবং ২ জন নতুন বোর্ড সদস্য সংযুক্ত করা হয়েছে উল্লেখ করে চিঠি দেয়।
১৫ ফেব্রুয়ারী সকাল সাড়ে ৮টার দিকে স্থানীয় কিছু ক্ষমতাসীন দলের লোকজন এবং কিছু মহিলা অফিসের সামনে অবস্থান নেয়; এবং ্ইউনূস সেন্টারের কোনো অফিস স্টাফকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না। এসময় ওইসব লোকজনকে “জয়বাংলা” শ্লোগান দিতে দেখেছেন স্থানীয় বেশ কয়েকজন।
এদের মধ্যে রতন দাস নামের একজন জানালেন, “আমি এই এলাকায় প্রায় ১৫ বছর ধরে থাকি। যারা ওই দিন ইউনূস সেন্টারের সামনে অবস্থান নিয়েছিল, তাদের অনেকেই স্থানীয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের।
তিনি জানালেন, মীরপুর বাংলা কলেজ থেকেও বাস ভরে বেশ কিছু ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এসেছিল। আর যে মহিলাদের দিয়ে মিছিল করানো হয়েছিল সবাইকেই নগদ টাকা দেয়া হয়েছে বলে ওই নারীরা বলাবলি করছিল বলে রতণ দাস দেখেছেন। সব মিলিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি সাড়ে ৩ থেকে ৪’শ জন ছিলেন ওই দিনের অবস্থানে। এরা সবাই ছিল ক্ষমতাসীন দলের সদস্য। এসময় মোবাইল ফোনে ওই বিক্ষোভের যারা ছবি তুলছিলেন, ভিডিও করছিলেন তাদের সাথেও দূর্ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন রতণ দাস। বেলা ১১টার দিকে অবশ্য বিক্ষোভকারীরা সবাই চলে যান।
এসময় এই সড়কের রাইনখোলা মোড়ে ওই দিন সকাল থেকে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু ইউনূস সেন্টারের সামনে বিশৃঙ্খলাকারী কাউকে বাঁধা দিতে দেখা যায়নি বলে জানান জালাল মিয়া নামের চায়ের দোকানী। বরং বিক্ষোভকারীদের সাথে আলাপ করেছে, চাও খেয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ।
অবশ্য ইউনূস সেন্টারের কর্মীরা অভিযোগ করেন, ১৫ তারিখ ইউনূস সেন্টার একটি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিল। সেই প্রোগ্রাম ভন্ডুল করতেই সকাল থেকে স্থানীয় লোকজনদের দিয়ে শ্লোগান দিয়ে একটি ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই আন্দোলন বা প্রক্রিয়ার সাথে গ্রামীণ পরিবারের কোন সদস্য ছিলেন না বলেও জানান তারা।
ইউনূস সেন্টারের একাধিক কর্মীর সাথে কথা বলে জানাগেছে, ১৫ তারিখের পর থেকেই তাদের মধ্যে এক ধরনের ভয় কাজ করছে। ইউনূস সেন্টারের প্রায় ৮’শ কর্মীর কেউই নিরাপদ নয় বর্তমান পরিস্থিতিতে।
তাদের অভিযোগ ১২ ফেব্রুয়ারীর ওই ঘটনার পর ১৩ তারিখ শাহ্ আলী থানায় সাধারণ ডাইরী করার জন্য লিখিত আবেদন করেন গ্রামীন কল্যাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম মইনুদ্দিন চৌধুরী। কিন্তু পুলিশ সেই অভিযোগ গ্রহন করেনি। উল্টো সরেজমিন পরিদর্শন করে এমন কোনো ঘটনার আলামত পুলিশ পায়নি বা ঘটেনি বলে জানিয়ে দিয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালে নোবেল জয়ী প্রফেসর ড. ইউনূস গ্রামীন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ ছেড়ে দেন। ওই সময় থেকে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ করা হয় একজনকে। তবে, সরকার খন্দকার মোজাম্মেল হককে নিয়োগ দেয়। ২০১৯ সালের ৮ আগস্ট মোজাম্মেল হকের মৃত্যুর পর থেকে সরকার কর্তৃক এ কে এম সাইফুল মাজিদ নিয়োগ প্রাপ্ত হন।
এর পর থেকেই গ্রামীণ কল্যাণ, টেলিকমসহ ৮টি প্রতিষ্ঠানই দখলের পায়তারা শুরু করে একটি চক্র। যার সাথে ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ ইন্ধন, সমর্থন ও সহযোগীতা রয়েছে বলে অভিযোগ অনেকটাই প্রকাশ্য। তবে, রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোশকতায় এই প্রক্রিয়াটি চলায় নানা ধরনের ভয় কাজ করছে কর্মীদের মধ্যে।
এসব অভিযোগ অবশ্য এ কে এম সাইফুল মাজিদ অস্বীকার করেছেন। সবই নিয়মতান্ত্রীক পদ্ধতিতে হচ্ছে এবং এর সাথে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলেও জানান তিনি।