কক্সবাজারের মহেশখালীতে ভাসমান তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনালে ত্রুটির কারণে সারা দেশে গ্যাসের তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এতে বেড়েছে দুর্ভোগ। গ্যাসের সংকটে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পোশাক, সিরামিক, সিমেন্ট ও ইস্পাতসহ বিভিন্ন খাতে উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাসের চাপের তারতম্যের কারণে কারখানার যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিল্প মালিকরা। ওদিকে গ্যাস সংকটে আবাসিক গ্রাহকরাও চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। বাধ্য হয়ে বাসাবাড়িতে রান্নার কাজ হচ্ছে মাটির চুলায় ও সিলিন্ডার গ্যাসে। এতে ক্ষোভে ফুঁসছেন আবাসিক গ্রাহকরা। এদিকে সিএনজি পাম্পেও গ্যাস সংকট। গ্যাসের চাপ না থাকায় প্রায় প্রতি পাম্পেই বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। সরজমিন কারাখানা ও আবাসিক এলাকা ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্রমতে, গত কয়েক বছর ধরে ঢাকায় শীতকালে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ার ফলে যে সমস্যা দেখা দিতো এবার তা আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে।
গ্যাস সংকটের কারণে শিল্প কারখানার সার্বিক উৎপাদন ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। গ্যাস সংকটের কারণে ডায়িং ও শিল্প-কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সময়মতো শিপমেন্ট (রপ্তানি প্রক্রিয়া) করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বিদেশি বায়াররা ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে রপ্তানি কার্যক্রমে ধস নামবে বলে আশঙ্কা করছেন উদ্যোক্তারা। তারা জানান, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে স্থবিরতা বিরাজ করছে। গ্যাস সংকটে গাজীপুরের কোনাবাড়ী, কালিয়াকৈর, কাশিমপুর ও এর আশপাশের এলাকার বেশিরভাগ কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে। গত এক সপ্তাহ ধরে এই সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। শ্রমিকরা কারখানায় আসছেন ঠিকই কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে কাজ করতে পারছেন না। এতে কারখানা মালিকরা পড়েছেন মহাবিপদে। প্রতিদিন তাদের লাখ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
উদ্যোক্তারা জানান, গাজীপুর ও ফতুল্লায় কয়েকদিন ধরে গ্যাসের চাপ শূন্যে নেমেছে। এতে পোশাক কারখানা, ডায়িং কারখানা, স্পিনিং, টেক্সটাইল, রি-রোলিং মিলসহ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করা না হলে রপ্তানি বাণিজ্যে মারাত্মক ধস নামার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। তাছাড়া এতে দেশের অর্থনীতিও চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
কারখানা মালিকরা বলছেন, বয়লার চালানোর জন্য প্রতি ঘনফুটে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ থাকা দরকার। কিন্তু অনেক কারখানায় চাপ কমে প্রতি ঘনফুটে ১ থেকে ২ পিএসআইতে দাঁড়িয়েছে। কোথাও কোথাও শূন্যে নেমেছে। তারা বলেন, একদিকে ডলার ক্রাইসিস অপরদিকে গ্যাস সংকট চলতে থাকলে এ সেক্টরে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে।
এদিকে গ্যাস সংকটে আবাসিক গ্রাহকরাও চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে অভিযোগ আসছে, গত এক সপ্তাহ ধরে ঢাকার আবাসিক এলাকায় দিনের অধিকাংশ সময় গ্যাস থাকছে না। যার কারণে রান্নার কাজে তীব্র ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে গৃহিণীদের। সকালে গ্যাসের চাপ কিছুটা থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা কমে আসছে। যার কারণে অনেক বাসা ও রেস্টুরেন্টে বিকল্প ব্যবস্থা রাখতে হচ্ছে।
রাজধানীর ডেমরা, মাতুয়াইল, যাত্রাবাড়ী, বকশিবাজার, পুরান ঢাকা, ধানমণ্ডি, কুড়িল, মহাখালী, নদ্দা, বসুন্ধরা, ভাটারা, বাড্ডা, বনশ্রী, রায়েরবাজার, শাহজাহানপুর, পল্টন, কলাবাগান, মিরপুর, ভাষানটেক, পল্লবী, কামরাঙ্গীরচর, মোহাম্মদপুর, কাজীপাড়া, নয়াটোলা, মীরবাগ, উত্তর বাসাবো, আজিমপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের চাপ কম রয়েছে। যার কারণে এসব এলাকায় রান্নার কাজে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে গ্রাহকদের। ইমাম উদ্দিন নামে এক গ্রাহক বলেন, গ্যাসের চাপ নাই। যার কারণে বাসায় রান্নার কাজে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। সকালে ও রাতে কিছুটা পাওয়া গেলেও দুপুরে একেবারেই থাকে না।
শান্তিনগরের বাসিন্দা আফরোজা বেগম বলেন, শীত শুরুর পর থেকে দিনের বেলায় সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ যেতো কমে। মিট মিট করে জ্বলা চুলায় রান্না হতো না। সপ্তাহ খানেক ধরে পরিস্থিতি আরও খারাপ। এখন এক সপ্তাহ ধরে সকাল ৭টায় গ্যাস সম্পূর্ণ চলে যাচ্ছে, আসছে ঠিক রাতের ১১টার দিকে। ফলে দিনের বেলায় রান্না করা সম্ভব হচ্ছে না।
উত্তর বাড্ডার বাসিন্দা শাকিলা বলছিলেন, তিনদিন ধরে চুলায় গ্যাস আসছে না। বিকল্প উপায়ে রান্নার কাজ সারছেন তারা। খাওয়া তো আর বন্ধ রাখা যায় না।
রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলের বাসিন্দারা গ্যাস সংকটের কারণে গত চারদিন ধরে কাঠের চুলা, কেরোসিন স্টোভ ও অন্যান্য অস্থায়ী পদ্ধতি অবলম্বন করছেন।
আবাসিকে গ্যাস সংকটের কথা স্বীকার করছে তিতাস কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি, শীতে সঞ্চালন লাইনে সমস্যার কারণেই এই সংকট। ১৯শে জানুয়ারির মধ্যে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস ছিল। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি।
এলএনজি টার্মিনালে ত্রুটি ও শীতের কারণে গ্যাস সরবারহ ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিটারা। গত শুক্রবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, কক্সবাজারের মহেশখালীতে অবস্থিত এলএনজি টার্মিনালে কারিগরি ত্রুটির কারণে চট্টগ্রাম এলাকায় গ্যাস সরবরাহ সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। দেশের অন্যান্য এলাকায় শীতের কারণে গ্যাসের স্বল্প চাপ বিরাজ করছে।
গ্যাস সংকটের বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ২০২৬ সালের মধ্যে দেশে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের কাজ চলছে। তবে সম্প্রতি যে সংকট চলছে সেটি কিছুদিনের মধ্যে সমাধান হবে।
সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোতে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ার কারণে গ্যাসের জন্য অপেক্ষমান গাড়ির প্রতীক্ষার সময়ও দীর্ঘতর হচ্ছে। সব মিলিয়ে গ্যাসের স্বল্পতা ভোগাচ্ছে দেশবাসীকে।
ঢাকার সাত রাস্তার সিটি ফিলিং স্টেশনে কথা বলে জানা যায়, সিএনজি গ্যাস রূপান্তর করার জন্য ২০০ বার চাপের গ্যাসের প্রয়োজন হলেও গত তিনদিন ধরে এসব ফিলিং স্টেশনে ১৩০ থেকে ১৪০ বার চাপের গ্যাস আসছে। ফলে নানা উপায়ে গ্যাসের চাপ বাড়াতে গিয়ে অনেক সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গ্যাসের জন্য অপেক্ষমান যানবাহনের লাইনও দীর্ঘ হচ্ছে।
জানা গেছে, গ্যাস সংকটের কারণে অনেক শিল্প-কারখানা দিনে বন্ধ রাখতে হচ্ছে। গাজীপুর, সাভার, কোনাবাড়ী, নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশের শিল্পাঞ্চলে চলছে এই সংকট।
গাজীপুরের এবিএম ফ্যাশন লিমিটেডের এজিএম মিলন বলেন, যেখানে ফ্যাক্টরির গ্যাস বিল আসতো মাসে কোটি টাকা সেখানে ডিজেল দিয়ে চালানোর ফলে ঘণ্টায় খরচ হচ্ছে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এ অবস্থায় ফ্যাক্টরির বয়লার মেশিন চালাতে অনেকেই হিমশিম খাচ্ছে। সময়মতো ডেলিভারি দেয়া যাচ্ছে না। এ এলাকার শতভাগ রপ্তানিমুখী বেশির ভাগ গার্মেন্টস কারখানার একই চিত্র পাওয়া গেছে।
একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের আশ্বাস দিয়ে প্রতি ইউনিট ১১ থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। তারপরও গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক না থাকায় পণ্য বিদেশে রপ্তানি অর্ধেকে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে গ্যাস সংকট চরমে উঠেছে। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও সাভার এলাকায় সংকট বেশি; যে কারণে এসব এলাকার ডায়িং কারখানাগুলো অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, তীব্র গ্যাস সংকট চলছে। দিনে বা রাতে কোনো সময়ই গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। গ্যাস সংকট তীব্র হওয়ার কারণে উৎপাদন একেবারেই বন্ধ রয়েছে। গ্যাসের এমন সংকট চলতে থাকলে কারখানা বন্ধ হবে। উৎপাদন ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে গেছে। শ্রমিকেরা কাজ হারাবেন।
দেশের অন্যতম স্টিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএমের এক কর্মকর্তা বলেন, গ্যাস সংকটে তাদের জ্বালানি চাহিদার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ডিজেল ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে।
সিরামিক শিল্পের অন্যতম প্রধান উপকরণই গ্যাস। ফলে চলমান সংকটে এই ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতিও হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ফার সিরামিকস লিমিটেডের এক কর্মকর্তা বলেন, তাদের কারখানায় গ্যাসের চাপ কমপক্ষে ১০ পিএসআই (চাপের একক) থাকতে হয়। কিন্তু দিনের বেলা বেশিরভাগ সময়ই চাপ থাকে দুই থেকে চার পিএসআই। ফলে পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে।
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইরফান উদ্দিন বলেন, গ্যাসের চাপ কম থাকায় দিনের একটা বড় অংশ আমাদের কারখানা বন্ধ রাখতে হয়। ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ার পাশাপাশি যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতেও আছি আমরা।
একটি সিমেন্ট কারখানার কর্মকর্তা বলেন, গ্যাস সরবরাহ কম থাকায় ক্ষতির মুখে পড়েছে সিমেন্ট খাত। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু এখন গ্যাসের সরবরাহ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান, এলএনজি আমদানি করতে হয় স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) থেকে। ডলার সংকটের কারণে এই মুহূর্তে এলএনজি আমদানি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কম। কিন্তু এখন এলএনজি টার্মিনালে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানান তারা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম গণমাধ্যমকে বলেন, আমদানির ক্ষেত্রে একটা স্থবিরতা আছে। এই মুহূর্তে কোনো স্বল্পকালীন সমাধান নাই। এই জ্বালানি সংকট যেটা সেটা ডলারের সংকট না কাটলে স্বল্পকালীন কোনো সমাধান নাই।