সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবলভাবে সরকার-সমর্থক বলে পরিচিত এক বন্ধু দিন কয়েক আগে ছাদে কাঠের চুলায় রান্নার একটি ছবি শেয়ার করেছেন! প্রিয় বন্ধুরা! ঢাকার বুকে মাটির উনুনে রান্নার অভিজ্ঞতা! ছবি ও ক্যাপশনে কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না ক্ষোভ ও শ্লেষের জায়গাটা। রাগ-ক্ষোভ-অসন্তোষ ঝাড়তে অবশ্য রাখঢাক করছেন না অনেকে।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামের মতো শহরগুলোতে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। ঢাকার অপেক্ষাকৃত গরিব এলাকার কয়েকটিতে এমনিতেই তিতাস সারা বছর ধরে যেভাবে গ্যাস সরবরাহ করে, তাতে মধ্যরাত থেকে ভোররাতের মধ্যে রান্না না হলে রীতিমতো ভর্তাভাত দিয়ে খেয়ে দিন পার করতে হয়। কিন্তু মাস শেষে গ্যাসসংযোগের জন্য সরকার নির্ধারিত বিল ঠিকই দিতে হয়। চাপা অসন্তোষ আর গোটা দীর্ঘশ্বাস গিলে নিয়ে তাঁরা এটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
কিন্তু শীত এলেই গ্যাসের সমস্যা বিরাট এলাকাজুড়ে আবির্ভূত হয়। সারা দিন তীর্থের কাকের মতো বসে থাকার পর হয়তো রাতে চুলা জ্বলে ওঠার মতো গ্যাস পান তাঁরা। কিন্তু এবার বহু বছর পর মাঘের শীত ঢাকায় যেভাবে জেঁকে বসেছে, তাতে কজনায় আর কম্বল-কম্ফর্টারের ওম ছেড়ে রান্না করতে ছুটবেন। ফলে চাহিদা বাড়ছে রাইস কুকার, আর মাইক্রোওয়েভ ওভেনের। তাতে নয় ঠেকায় রান্না হলো। কিন্তু এই ভোগান্তি বিশাল অংশের মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে, তা প্রশমনের বিকল্প তো পথ নেই।
শীতে গ্যাসের এ রকম ভোগান্তির একটা গৎবাঁধা কারিগরি ব্যাখ্যা অবশ্য থাকে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ও পেট্রোবাংলার। তারা ব্যাখ্যা দেয়, শীতে তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় পাইপলাইনে তরল পদার্থ জমে গ্যাসপ্রবাহের চাপ কমে যায়। কিন্তু এ বছর গ্যাসের সংকট অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশ বেশি। তার ব্যাখ্যা কী? জ্বালানিবিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্নকথা। দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় উৎপাদন কমেছে। আর বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি কমেছে।
ভোগান্তিতে এবার নতুন মাত্রা যুক্ত হলো এলএনজি সরবরাহে কারিগরি সমস্যা দেখা দেওয়ায়। হঠাৎ পুরো চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে। অভাবিত পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয় মানুষকে। মানুষ দৌড়াতে থাকে এ বাজার থেকে আরেক বাজার। রাইস কুকারের সন্ধানে। কিন্তু অতি চাহিদার তুলনায় জোগান তো আর নেই। ফলে অনেককে শুকনা খাবার খেয়ে কিংবা না খেয়েই দিন কাটাতে হয়। মাঝরাস্তায় গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ায় রাস্তার মাঝেই থেমে যায় অনেক গাড়ি। দৃশ্যকল্পটা মনে হতে পারে, হলিউডের কোনো মুভির দৃশ্য।
আমাদের এখন মোট জ্বালানির যে চাহিদা, তার বড় অংশের জোগান আসে গ্যাস থেকে। আর গ্যাসসংকটের মূল ধাক্কাটা গিয়ে লাগছে অর্থনীতিতে। ভারী শিল্প থেকে শুরু করে মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প—সবাই ভুক্তভোগী হচ্ছে। গ্যাস না পাওয়ায় অনেকটা সময় কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন করতে পারছে না। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। রপ্তানিমুখী শিল্পে অনেকে ঠিকমতো শিপমেন্ট করতে পারছে না। গ্যাসের চাপ কমছে আর তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়ছে।
ডলার ও জ্বালানিকে কেন্দ্র করে এই যে সংকট, তার বয়সও করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মিলিয়ে প্রায় চার বছর হতে চলল। কিন্তু সংকট থেকে শিক্ষা নিতে হয়—সেই শিক্ষাই আমরা নিই না।
অথচ গত বছরের জানুয়ারি মাসে শিল্পে যখন একধাপে গ্যাসের দাম ১৮০ শতাংশ বাড়ানো হলো, তখন সরকারের প্রতি ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দাম বাড়ানোর আগে গ্যাসের যে সরবরাহ ছিল, বর্তমান পরিস্থিতি আরও খারাপ। তখনই অনেকে বলেছিলেন, দাম বাড়িয়ে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর কোনো পথ নেই। কারণ দাম বাড়ছে টাকায়। আর জ্বালানি কিনে আনতে হয় ডলারে। বাস্তবেই তা-ই হয়েছে।
গ্যাস না পাওয়ায় শিল্পকারখানার উৎপাদন পরিস্থিতি কতটা শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার একটা আঁচ পাওয়া যায় সম্প্রতি প্রথম আলোর নতুন সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে।
বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, গ্যাসসংকটে দেশের কারখানার উৎপাদন ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমেছে। ট্রিলিয়ন ডলারের (এক লাখ কোটি) অর্থনীতির কথা বলা হচ্ছে, ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানির পরিকল্পনা হচ্ছে, অথচ কারখানায় গ্যাস নেই।
আর প্রথম আলোর ২২ জানুয়ারির প্রতিবেদন বলছে, চট্টগ্রামে বন্দর ঘিরে যে শিল্প গড়ে উঠেছে, গ্যাসসংকটের কারণে কারখানা যেমন মাঝেমধ্যে বন্ধ রাখতে হচ্ছে, আবার অনেক উদ্যোক্তাকে সক্ষমতার ৫০ শতাংশ চালাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। সেখানকার ভারী শিল্পে উৎপাদন কমেছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে অর্থনৈতিক সংকট, অনেকে তার মূল দায় দেন জ্বালানির ওপর। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে সামষ্টিক অর্থনীতি যখন স্থিতিশীল ছিল, রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ে ভর করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ডলারে ভর্তি হয়ে যাচ্ছিল, সে সময়ে সেই ডলার দিয়ে বাইরে থেকে জ্বালানি কিনে আনার সহজ রাস্তা বেছে নেয় সরকার। দেশীয় উৎস অনুসন্ধান বন্ধ করে আমদানিনির্ভর জ্বালানি নীতিতে হাতে গোনা কিছু মানুষের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে। কিন্তু গ্রামের সাধারণ গৃহস্থ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ বিদেশি মুদ্রা নিয়ে আসা ব্যবসায়ী সবাইকেই ভয়াবহভাবে ভুগতে হচ্ছে।
ডলার ও জ্বালানিকে কেন্দ্র করে এই যে সংকট, তার বয়সও করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মিলিয়ে প্রায় চার বছর হতে চলল। কিন্তু সংকট থেকে শিক্ষা নিতে হয়—সেই শিক্ষাই আমরা নিই না।
সংকটে পড়ে চার বছরে ৪৬টি কূপ খননের যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে, দুই বছর শেষে তার বাস্তবায়নের চিত্রই বলছে এ ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা কতটুকু। ২০২২ ও ২০২৩ সালে ২১টি কূপ খননের কথা থাকলেও খনন করা হয়েছে মাত্র ৯টি। আর জাতীয় গ্রিডে দিনে ২৮ কোটি ঘনফুট যুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও যুক্ত হয়েছে মাত্র আড়াই কোটি ঘনফুট। সামগ্রিকভাবে দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস উৎপাদনের চিত্র হতাশাজনক।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতা নেয়, তখন নিজস্ব মজুত থেকে দৈনিক গ্যাসের সরবরাহ ছিল প্রায় ২ হাজার ৭৫৫ ইউনিট (এমএমসিএফটি)। গত বছর সেটি ২ হাজার ১৬০ ইউনিটে নামে।
গ্যাস-জ্বালানির এ-ই যখন হালচাল, গৃহস্থ থেকে শিল্পোদ্যোক্তা—সবাইকে ভুগতে হচ্ছে সমানে। এর মধ্যেই আবার বাসাবাড়িতে গ্যাসের বিল বাড়ানোর আবদার জানিয়েছে তিতাস। একলাফে ৫১২ টাকা। অথচ গ্যাসের ক্ষেত্রেও সিস্টেম লস নামের একটা শুভংকরের ফাঁকি তারা চালু রেখেছে। পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের বেলায় সিস্টেম লসের কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। এটা চুরি। বছরের পর বছর ধরে গ্যাসের এই সিস্টেম লস চলে আসছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, এই চুরি হওয়া গ্যাস দিয়ে কমপক্ষে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।
গ্যাসসংকটের সমাধান না করে, সিস্টেম লসের নামে চুরি বন্ধ না করে রাজস্ব আয়ের সহজ বিকল্প হিসেবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি কি থাকতে পারে?