প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৈরী পোশাক খাতের মতো করে দেশের তিনটি রপ্তানি খাত- চামড়া, পাট ও কৃষিতে প্রণোদনা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এই কৌশলগত পদক্ষেপের লক্ষ্য হচ্ছে, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কাঁচামাল খাত থেকে রপ্তানি আয় বাড়ানো এবং পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরতা কমানো। দেশের প্রধান রপ্তানি খাত পোশাক শিল্প এমনিতেই পশ্চিমা বিভিন্ন পদক্ষেপ ও শ্রম অধিকার ঘাটতির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জরিমানার কবলে পড়তে যাচ্ছে।
বির্তকিত নির্বাচনের জন্য বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে পোষাক রপ্তানিতে শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো বাংলাদেশের ওপরে চলে আসবে। এ অবস্থায় সরকার এখন পোষাক খাত বাদ দিয়ে অন্য তিনটি খাতে রপ্তানি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে চাচ্ছে।
সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে এ নির্দেশনা জারি করেন। ক্যাবিনেট সচিব মাহবুব হোসেন এ বৈঠক শেষে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের কাছে এ নিদের্শনার কথা উল্লেখ করেন।
তিনি আরো বলেন, এ তিনটি খাতকে রপ্তানি ক্ষেত্রে কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায় তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো এক যোগে কাজ করবে। আলোচনা ও পর্যালোচনা করে সুবিধা দেওয়ার উপায় বের করা হবে ।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের গার্মেন্ট খাতের মতো ক্যাশ, পণ্য বহুমুখীকরণ ও রপ্তানির জন্য নতুন দেশ খোঁজার ক্ষেত্রে সুবিধা দেওয়া যেতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গার্মেন্ট ব্যবসায়ী বাংলা আউটলুককে বলেন, দেশের গার্মেন্ট খাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা ও জরিমানার মধ্যে পড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। এখন খাতকে ছাড়া গরুর মতো খোলা মাঠে ছেড়ে দিতে চায় সরকার।
তিনি আরো বলেন, সরকার শেষ পনেরো বছর পোষাক খাতে রপ্তানি বহুমুখীকরণ পদক্ষেপ নিলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এটা কার্যকর করতে পারেনি। শ্রম অধিকারের বিষয়টি সরকারের, এ দোষ আমাদের নয়।
কয়েক বছর ধরে চামড়া ও পাট শিল্প থেকে রপ্তানি আয় প্রায় ১ বিলিয়ান ডলারে স্থবির হয়ে আছে। এই খাতের রপ্তানিতে সাম্প্রতিক পতনের প্রতিক্রিয়া হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কর্পোরেট ট্যাক্স ছাড়, পোশাক খাতের অনুরূপ বন্ড সুবিধা, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে অতিরিক্ত ঋণ এবং নগদ প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সুবিধা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে কৃষি খাতের রপ্তানি ১ বিলিয়ান ডলারের ঘর অতিক্রম করেছে।
সরকার বর্তমানে পাটজাত পণ্যের জন্য ৭% থেকে ২০% এবং চামড়াজাত পণ্যের জন্য ১০% থেকে ১৫% পর্যন্ত রপ্তানি প্রণোদনা প্রদান করে। ১৯৮০-এর দশকে গার্মেন্টস সেক্টর ২৫%-এর বেশি প্রণোদনা উপভোগ করেছিল, পরে ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে তা ২০%-এ নেমে আসে। এই সমর্থন পোশাক শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
অর্থনীতিবিদরা রপ্তানি বহুমুখীকরণের গুরুত্বের ওপর জোর দেন। রপ্তানি ক্ষেত্রে একটি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতাকে অনিশ্চিত বলে মনে করেন। সরকারি উদ্যোগ সত্ত্বেও রপ্তানি বহুমুখীকরণ ঘটেনি। গত অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪% পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি হয়েছে মোট ১ দশমিক ২২ বিলিয়ান, যা সেই বছরের রপ্তানি আয়ের মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এ খাতের রপ্তানি ৫২৩ মিলিয়ান ডলারে পৌঁছেছে।
একইভাবে, ২০২২ অর্থ বছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ান মার্কিন ডলার, যা সেই বছরের মোট রপ্তানির মাত্র ৩% ছিল। গত অর্থ বছরে, এ খাতের রপ্তানি কমেছে ৯১২ মিলিয়ান মার্কিন ডলার, বা মোট রপ্তানির ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
এর আগে গত ১১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের সভাপতিত্বে চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পের উন্নয়ন ও রপ্তানি নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাট খাতের উন্নয়ন নিয়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে।
পোশাক শিল্প মালিকরা বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদে ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারেন। অন্যদিকে চামড়া খাতে সর্বোচ্চ ঋণ সুবিধা ৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ইডিএফের সার্কুলারে পাট রপ্তানিকারকদের জন্য ঋণ সুবিধার কথাও বলা হয়েছে। তবে এই পাট রপ্তানিকারকরা এই তহবিল থেকে কোনো ঋণ নিতে পারছেন না।
তৈরী পোশাক শিল্প, চামড়া খাত ও পাট খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তৈরী পোশাক শিল্পের জন্য তিন বছর মেয়াদি বন্ড লাইসেন্স সুবিধা থাকলেও লেদার, ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর সদস্যরা দুই বছরের জন্য বন্ড লাইসেন্স সুবিধা পাচ্ছেন। অন্যদিকে পাট খাতের জন্য বন্ড লাইসেন্স সুবিধা নেই।
বিজিএমইএ ও বিকেএমই-এর সদস্যরা বন্ড লাইসেন্স অডিটের জন্য দুই বছর সময় পেলেও ট্যানারিতে প্রতিবছরই অডিট করতে হয়।
গার্মেন্ট শিল্প মালিকরা কাঁচামালের বার্ষিক আমদানি প্রাপ্যতার ভিত্তিতে উৎপাদনের আগে কাঁচামাল ব্যবহারের জন্য ইউটিলিটি অনুমতি এবং ইউটিলিটি ঘোষণা বিজিএমইএ বা বিকেএমইএ থেকে নিতে পারেন। চামড়া খাতের রপ্তানিকারকদের কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট থেকে এই সুবিধা নিতে হয়। যা অত্যন্ত কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ।