অলিউল্লাহ নোমান
রোজার মাসে ইফতার মাহফিল/ইফতার পার্টি নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ হয়েছে রমজানের প্রথম দিনে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যায়ে গণ-ইফতারের সচিত্র প্রতিবেদন রীতিমত ভাইরাল। ভারতীয় ভ্রাহ্মণ্যবাদি সংস্কৃতির আগ্রাসন এবার রোজায় ইফতার মাহফিলে আঘাত হানার চেষ্টা করেছিল। রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ে গরুর গোস্ত নিষিদ্ধ করার দাবীও উঠানো হয়েছিল। যারা ইফতার মাহফিল বন্ধ করতে চায় এবং গরুর গোস্ত নিষিদ্ধ করার দাবী জানায়, তারাই মূলত এদেশের স্বাধীনতার মূল শত্রু। যারা এদেশের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ভারতীয় সংস্কৃতিতে মিশিয়ে দিতে চায় তাদেরই আপত্তি ইফতার মাহফিল ও গরুর গোস্তে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে ভারতের কাছে বিকিয়ে দেওয়া হয়েছে আরো আগেই। ২০০৭ সালের জরুরী আইনের সরকার সার্বভৌমত্ব ভারতের হাতে বিকিয়ে দিয়ে সাজানো নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। অতপর, শেখ হাসিনা প্রকাশ্যেই বলেছিলেন ভারতকে যা দিয়েছি তা সারাজীবন মনে রাখতে হবে। বাংলাদেশটা যেন শেখ হাসিনার বাবার তালুকদারি। তিনি যা ইচ্ছা সবই ভারতকে দিয়েছেন। জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। সবকিছু ভারতে দেওয়ার ধারাবাহিকতায় এখন ধর্মীয় সংস্কৃতির উপর চুড়ান্ত আঘাত শুরু হয়েছে। রোজায় ইফতার মাহফিল বন্ধ ও গরুর গোস্ত নিয়ে প্রকাশ্যে আপত্তি উঠছে। তবে আশার আলো হচ্ছে নীরব প্রতিবাদী তরুণরা। ভারতীয় আধিপত্যবাদের দোসরদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণ-ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে।
শত শত বছরের ঐতিহ্য হচ্ছে রমজানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা। কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন লেগেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও। ভারতীয় ভ্রাহ্মণ্যবাদের দোসর ফ্যাসিবাদী সরকার শত বছরের ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিয়ে রমজানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে নালিশ করা হয়েছিল। তবে এই আদালত তো আরো আগেই ভারতের কব্জায় চলে গেছে। বাকশাল ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সম্পাদকের নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগ থেকে সরকারের ফরমান বহাল রাখা হয়েছে। ভারতীয় সংস্কৃতির কব্জায় চলে যাওয়া উচ্চ আদালত থেকে এর বাইরে প্রত্যাশা করাটাও ঠিক নয়। ছাত্রলীগের গুণ্ডাপাণ্ডাদের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকের পদে বসানো-ই হয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এই বিচারকরা ভুলে গেছেন, করুনা মহামারির অজুহাতে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পুরো বছর বন্ধ রাখা হয়েছিল। এখনো পাবলিক পরীক্ষা নিয়মিত নেওয়া শুরু হয়নি। অথচ, রমজানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় তারাই সমস্যা খুঁজছেন। ভারতীয় আধিপত্যবাদিরা জানেন রমজানে এদেশের হাজারো তরুণ পবিত্র কোরআন শিক্ষায় মনযোগি হয়। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকে এই সময়ে। তাই পবিত্র মাসকে তরুণরা কোরআন শিক্ষার জন্য উপযুক্ত সময় মনে করেন। আর এই সুযোগটি বন্ধ করতেই স্কুল খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতীয় আধিপত্যবাদের কব্জায় থাকা সরকার। ১৯৪৭ সালের আগে বৃটিশ আমলে তৎকালিন মুসলিম বাংলাকে নানাভাবে বঞ্চিত রেখেছিল ভ্রাহ্মণ্যবাদিরা। শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে রাখা হয়েছিল এই অঞ্চলকে। শোষণ ও নিপীড়নই ছিল এই মুসলিম বাংলার মানচিত্রের মানুষের নিত্যসঙ্গী। এই শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির জন্যই মানুষ ১৯৪৭ সালে পৃথক আবাসভূমির দাবী করেছিল। এই দাবীর প্রেক্ষিতেই পর্যায়ক্রমে আজকের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কিন্তু যারা ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি তারাই পরবর্তীকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের টার্গেট বানায় বাংলাদেশকে। ভারতীয় ভ্রাহ্মণ্যবাদের খুদ-কুড়ো খাওয়া দালালরা ভারতীয় সংস্কৃতির ওকালতি ও প্রসারে অপেচেষ্টায় লিপ্ত হয়। তারা মূলত: আবারো এই দেশ, জাতি ও মানচিত্রকে ১৯৪৭ সালের আগের জায়গায় নিয়ে যেতে চায়। তারা চায় ভারত আমাদের শাসন ও শোষণ করুক।
ইফতার মাহফিল বা ইফতার পার্টি যে নামেই বলা হউক, এটি রমজানে সামাজিক সংস্কৃতির অংশ। রোজায় ইফতার মাহফিল/ইফতার পার্টি, আরবি শাবান মাসের ১৫ তারিখে ধুমধামের সাতে শবে বরাত, বার-ই রবিউল আওয়ালে ঈদে মিলাদুন্নবী এ গুলো এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মানচিত্রের মানুষের সামাজিক সংস্কৃতি। এই আচার অনুষ্ঠান গুলোই এই মানচিত্রের মানুষের সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে।
বাংলাদেশ তথা এ অঞ্চলের মুসলমানের কাছে প্রচলিত শব্দ – নামাজ, রোজা, রমজান, ইফতার, সেহরি। এ গুলো আমাদের সংস্কৃতির অংশ। সংস্কৃতি ধ্বসে পড়লে সেখানে ধর্ম গর্তে চলে যায়। তাই পরিকল্পিতভাবে আমাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতেই মরিয়া ভারতীয় আধিপত্যবাদ। ভারতীয় আধিপত্যবাদের অপচেষ্টার মাঝে আগুনে ঘি ঢালার মত অবস্থায় নেমেছে একদল কথিত আলেম। তাদের ডিগ্রীর দৌড় কতটুকু জানি না। তবে ইউটিউবে তারা সরব নামাজ, রোজা, রমজান শব্দ নিয়ে। তারা এখন নামাজকে সালাত, রোজাকে রামাদ্বান বলা নিয়ে ফতোয়া দিচ্ছেন। এই কথিত আলেমরাই শবে বরাত ও ঈদে মিলাদুন্নবীর সামাজিক সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নানা ফতোয়া দিচ্ছেন। বাঙালি মুসলমানদের মধ্য থেকে শব-ই-বরাত, ঈদে মিলাদুন্নবীর সাংস্কৃতিক আবহটা ধ্বংস করে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে। নতুন করে শুরু হয়েছে ঈদ মুবারক বলা নিয়ে। এসব ফিতনা মূলত ভারতীয় আধিপত্যাবাদিদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পালে হাওয়া দিচ্ছে। ভারতীয় সাংস্কৃতির প্রচারক তথাকথিত প্রগতিশীল ও ধর্মীয় সামাজিক সংস্কৃতি নিয়ে নানা বিতর্কিত ফতোয়া দিয়ে ফেতনা সৃষ্টিকারী আলেমদের উদ্দেশ্য মূলত এক।
আজকের গণ-ইফতারের মত প্রতিবাদ পুরো রমজান অব্যাহত থাকুক। নামাজ, রোজা, রমজান, ইফতার মাহফিল স্বাধীনভাবে পালনের জন্য ১৯৪৭ সালে আমাদের পূর্বপুরুষরা যে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন সেই সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেওয়াই হউক আমাদের প্রতিজ্ঞা।