বিরোধী রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়া একতরফা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের রেশ কাটেনি। এরই মধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। চলতি বছরের মে মাস থেকে চার ধাপে অনুষ্ঠিত হবে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। দিন-তারিখ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচনের ‘রোডম্যাপ’ প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে।
এ নির্বাচনে প্রার্থীদের দলীয় প্রতীক দিচ্ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। স্থানীয় সরকারের সর্বশেষ দুই নির্বাচন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হওয়ার পর এবার কেন দলীয় প্রতীক থেকে সরে আসল ক্ষমতাসীন দলটি? এই নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। কেমন হবে এই নির্বাচন? সংঘাতের পথ বন্ধ হবে? নাকি আরও প্রসারিত হবে? এসব প্রশ্ন উঠছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেকরা বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন করা এই ইসির পক্ষে খুব সহজ হবে না, এটি প্রমাণিত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উন্মুক্ত প্রার্থী থাকলে এই নির্বাচনেও সংঘাতের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। তবে নির্বাচন কমিশন বলেছে, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে। কিছু নতুন পরিকল্পনাও তারা হাতে নিয়েছে বলে জানা গেছে।
২০১৫ সাল থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে শুরু হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় টিকে যায় আওয়ামী লীগ। কিন্তু এরপর স্থানীয় সরকারের বেশ কয়েকটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয় এবং জিতেও যায়।
একইভাবে ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভোট ‘চুরির’ অভিযোগ তুললেও পরে স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে অংশ নেয় দলটি। তবে ২০২১ সালে পর থেকে জাতীয় সংসদদের উপ-নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের সব ধরনের নির্বাচন বয়কট করে আসছে বিএনপি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি দলটি। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনেও অংশ না নেওয়ার বিষয়ে শক্ত অবস্থানে রয়েছে দলের দায়িত্বশীল নেতারা। ফলে নতুন সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে কোনো নির্বাচনে দেখা যাবে না দলীয় প্রার্থীদের।
এছাড়া বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় অবস্থানে রয়েছে। তবে জাতীয় সংসদের বিরোধীদল জাতীয় পার্টি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেবে বলে জানিয়েছেন দলটির দায়িত্বশীল নেতারা।
দেশের ৮টি বিভাগের ৬৪টি জেলায় মোট ৪৯৫ টি উপজেলা রয়েছে। সর্বশেষ পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালে। গতকাল মঙ্গলবার ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দিন তারিখ ঘোষণা করা হয়। এদিন বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ২৭তম কমিশনের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে নির্বাচন কমিশনের সচিব জাহাঙ্গীর আলম জানান, ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন চার ধাপে অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম ধাপের ভোট আগামী ৪ মে হবে।
১১ মে হবে দ্বিতীয় ধাপের ভোট। ১৮ মে তৃতীয় ও ২৫ মে চতুর্থ ধাপের ভোট গ্রহণ হবে। সাধারণত সব উপজেলায় একসঙ্গে নির্বাচন করা হয় না। একাধিক ধাপে এই নির্বাচন করা হয়। আইন অনুযায়ী উপজেলা পরিষদের মেয়াদ পূর্তির আগের ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হয়।
ইসি সচিব বলেন, ‘এখন ৪৫২টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচন উপযোগী হয়ে আছে। জুনের মধ্যে এসব উপজেলায় নির্বাচন করতে হবে। এছাড়া আগামী মার্চ মাসের মধ্যে অল্প কিছু বাদে প্রায় সব কটি উপজেলা নির্বাচন উপযোগী হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, ‘আমরা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করিনি। সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি আদায়ে আমরা রাজপথে রয়েছি। আমাদের আন্দোলনের কর্মসূচি চলমান। এ অবস্থায় সরকারের অধীনে কোনো ধরনের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চিন্তা ভাবনা বিএনপির নেই।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, আওয়ামী লীগ খেয়াল খুশি মত নির্বাচন করে নেওয়ার কৌশল নিয়েছে। তারা নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি, প্রতীক বাতিলের কোনো সিদ্ধান্ত নেই। তারা বলছে, এবার দলীয় প্রতীক দেবে না। জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, এই নির্বাচন নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই।
এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনের অংশ নেওয়া না নেওয়ার বিষয়ে আমরা এখন কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। নীতি নির্ধারণী ফোরামের বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘আগামী সপ্তাহে আমাদের সভা হতে পারে। এখনই আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না।’
জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি উপজেলা নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্তে আছে। তবে দলীয় ফোরামে এখনও বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়নি বলে জাপা সূত্রে জানা গেছে।
জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘আমরা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেব, তবে এখনও এই নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীকে মনোনয়ন দেবে না এটা তাদের দলের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমরা দলীয় প্রতীক নিয়েই নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবো।’
সুষ্ঠু নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখনই এই নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না, আগে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি দেখবো।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে আলোচনায় আসা তৃণমূল বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি। এখনও সিদ্ধান্ত নেইনি। আওয়ামী লীগকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। দলীয় প্রতীক থেকে সরে এসেছে।
তিনি বলেন, আমরা শুরু থেকেই বলছিলাম দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ সরকার সব কিছুই কুক্ষিগত করতে চায়। দেরিতে হলেও আওয়ামী লীগ তা বুঝতে পেরেছে। ফলে তারা দলীয় প্রতীক থেকে সরে এসেছে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দলীয় প্রতীক থেকে সরে আসার বিষয়টি ইতিবাচক। অতীতে আমরা দিখেছি দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের জন্য প্রার্থীর সংখ্যা কমে গেছে। যোগ্যপ্রার্থীর সংখ্যাও কমে গেছে। ফলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রার্থী নিবার্চিত হয়। সরকার দলের প্রভাবে বাণিজ্য অপকর্ম, টাকা পয়সার লেনদেন বেড়ে যায়। এটা অশনি সংকেত ছিল। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নির্বাচনে অংশ নেয়নি।
সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে ইসির সক্ষমতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনে সুষ্ঠু করতে পারেনি। কোনো উপ-নির্বাচন বা স্থানীয় নির্বাচনও সুষ্ঠু করতে পারেনি। তাদের ওপর ব্যাপক আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। মানুষের ব্যাপক আস্থাহীনতা। এর দায় তো ইসিকে নিতেই হবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নিজস্ব সমস্যার কারণে প্রতীকবিহীন নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাধারণ মানুষের আশা বাড়বে, সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতীকে নির্বাচন শুরু করা হয়েছে আওয়ামী লীগের সুবিধার জন্য। প্রতীক দেবে না, সেটাও তাদের সুবিধার সিদ্ধান্ত। সুতরাং প্রতীকে হলেই কী, না হলেই বা কী।’
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং নির্বাচন পরিচালনা বোর্ডের সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনের আমরা দলীয় প্রতীক দেব না, এটি আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। যেহেতু দলীয় প্রতীকই দেব না, সেক্ষেত্রে প্রার্থী বাছাই করার প্রয়োজন নেই। সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের জন্য সবার অংশগ্রহণের জন্যই এবার দলীয় প্রতীক দেওয়া হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইসিকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে। ইসি কিভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু করবে এটা তাদের বিষয়।’
নির্বাচন কমিশনের সচিব জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বিদ্যমান আইনে রাজনৈতিক দলের দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ আছে। কেউ যদি দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে চায়, তারা করতে পারে। তারা দলীয় সভাপতির ছবি ব্যবহার করতে চাইলেও করতে পারবেন। এখানে আইন পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন নেই।’
তিনি বলেন, ‘উপজেলা জেলা চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীক দেওয়ার বিধান রয়েছেন। ভাইস চেয়ারম্যান উন্মুক্ত। সংরক্ষিত ভাইস চেয়ারম্যান সবার জন্য উন্মক্তই ছিল। আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিয়েছে তারা চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীক দেবেন না। যারা নির্বাচন অংশগ্রহণ করবেন তারা স্বতন্ত্র হিসেবেই প্রার্থী হবেন।’
‘আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক দিচ্ছে না, সেক্ষেত্রে নির্বাচন অংশ গ্রহণমূলক না হওয়ার কোনো সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না’- উল্লেখ করে ইসি সচিব বলেন জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এমনিতেও অংশগ্রহণমূলক হবে।’