কী দিয়ে আওয়ামী লীগ বিজেপির ঋণ শোধ করবে?

0
73

ভারতে লোকসভা নির্বাচনের বেশি দেরি নেই। এপ্রিল-মে মাসেই নির্বাচন হবে। আগের দু’দফা নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কার্ড বিজেপি জোটকে যে ধরনের সুবিধা দিয়েছিল এবার সেটি একইভাবে কাজ করবে কি না এ নিয়ে বিশ্লেষকরা সন্দিহান। বিজেপি শাসনে ভারত নানা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যায় জর্জরিত। সমাজের হিন্দুত্ববাদী রূপান্তর নাগরিকদের ভাবিয়ে তুলেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে জাতিগত সংঘাত নতুন বড় সংকট তৈরি করেছে। নতুন নতুন বিভাজনের রাজনীতি দেশটিকে জর্জরিত করে তুলেছে। মানবাধিকার পরিস্থিতি ভীষণ নাজুক। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার তলানিতে এসে ঠেকেছে। মোদী সরকারের কর্পোরেট তোষণ নীতি ও বড় কর্পোরেটগুলোর দুর্নীতি সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। বড় বড় কৃষক আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে জনমতের প্রমাণ হিসেবে হাজির হয়েছে। আগে দুই নির্বাচনের আগে ভারতের মিডিয়া নরেন্দ্র মোদীকে যেভাবে ক্যারিশমাটিক ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরেছিল তাতে চিড় ধরেছে। এখন অনেক মানুষই বুঝতে পেরেছেন, হিন্দুত্ব, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ফাঁকা বুলির নিচে চাপা পড়তে চলেছেন তারা।

এতকাল রাহুল গান্ধী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে সুবিধা করতে না পারলেও তার ইন্ডিয়া মার্চ কর্মসূচি বেশ জনপ্রিয় ও সফল হয়েছে। তিনি নতুনভাবে ফিরতে পেরেছেন। নরেন্দ্র মোদীর বিপক্ষে কংগ্রেসের শক্ত প্রার্থী নেই বিজেপির এ প্রচারণা ফিকে হয়ে গেছে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট ভারতজুড়ে বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করতে পেরেছে। তবে বিজেপি এই জোটে ভাঙন ধরানোর ব্যাপারে খুবই তৎপর। পদ দিয়ে, উপঢৌকন দিয়ে, ভয় দেখিয়ে, পদচ্যুত করার হুমকি দিয়ে তারা জোটের যথেষ্ট ক্ষতি করেছে। তারপরও এই জোট ভাল করবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু জিতবে কি? বিশ্লেষকরা মনে করেন, গত দশ বছরের শাসনামলে বিজেপি সরকার ভারতের যে ভয়াবহ হিন্দুত্ববাদী রূপান্তর ঘটিয়েছে তা দেশটির বহু মানুষকে প্রভাবিত করতে পেরেছে। এর ফল বিজেপি অনেক দিন ধরে পাবে। এবার নির্বাচনের আগে বিজেপি যদি হিন্দুত্ববাদী কার্ড ঠিক মতো খেলতে পারে তবে জিতে আসতে তাদের খুব বেশি কষ্ট হবে না। হারলেও শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে শাসকদের ঘুম হারাম করতে পারবে তারা।

বিজেপি অবশ্য পরাজয়ের চিন্তা করছে না। তাদের মনোবল দৃঢ়। ভারতজুড়ে মুসলিম বিরোধী মনোভাব চাঙ্গা করতে তারা এরই মধ্যে বাবরি মসজিদের স্থানে রামমন্দির নির্মাণ করে সেটির উদ্বোধন করে ফেলেছে। নিয়মিতভাবে বিভিন্ন মসজিদকে পুরনো মন্দির আখ্যায়িত করে মিছিল-সমাবেশ করে আদালতের সম্মতি আদায় করে সেখানে পূজায় আয়োজন করছে। নির্বাচনের আগে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন প্রয়োগ করতে শুরু করেছে। যার লক্ষ্য আসাম-পশ্চিমবঙ্গ সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের বাঙালি মুসলমানরা। এখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠীকে দেশবিহীন করে রোহিঙ্গাদের মতো বাংলাদেশে পাঠানোর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা তারা সামনের দিনগুলোতে বাস্তবায়ন করবে বলে অনেকেই মনে করেন।

বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদীর জন্য এখন তীব্র মুসলিম-বিরোধী মনোভাব তৈরি করা দরকার। আগে নির্বাচনের আগে পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধংদেহী একটা অবস্থান ভোটারদের প্রভাবিত করতো। কিন্তু পাকিস্তান সীমান্তে এবার তেমন কিছু ঘটছে না। কেননা, রাজ্য হিসেবে কাশ্মীরের স্ট্যাটাস ক্ষুণ্ন করার পর সেখানে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করা ভারতের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে চীনের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব তৈরির চেষ্টা করছে মোদী সরকার। ভারতের মালদ্বীপনীতির ভরাডুবি থেকে দৃষ্টি সরানোর জন্যই বিজেপির এই তৎপরতা। মালদ্বীপকে সামাল দেওয়ার জন্য লাক্ষা দ্বীপে সেনা উপস্থিতি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অরুণাচল সীমান্তে সেনা উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। সেখানে একটি কৌশলগত স্থাপনা উদ্বোধনও করা হয়েছে। চীন সীমান্তে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব বিজেপিকে অতো সুবিধা না দিলেও কিছুটা সুবিধা তো দেবেই।

এর মধ্যে নরেন্দ্র মোদী ভারত ঘুরে ঘুরে ছোট-বড় নানা স্থাপনা উদ্বোধন করছেন।

এত কিছুর পরও জিতে আসার জন্য বিজেপির বড় কিছু দরকার। মুসলিম প্রধান কোনো প্রতিবেশী দেশে এমন ঘটনা দরকার যাতে বিজেপি ভারতের মানুষকে বোঝাতে পারে, দেখো বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে কী হচ্ছে। এজন্যই তো আমরা বলি, ভারতকে রক্ষার জন্য বিজেপির কোনো বিকল্প নেই। মুসলিমদের বিরেুদ্ধে জিতে থাকতে হলে, তাদের দমন করে রাখতে হলে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ছাড়া উপায় নেই।

পাকিস্তান থেকে এমন সহযোগিতা বিজেপি বোধহয় এবার পাবে না। কিন্তু বাংলাদেশ থেকেও কি পাবে না?

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারকে চার দফা নির্বাচনে জিতিয়ে এনেছে ভারত। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জিতিয়ে আনার সময় কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল। সেবার ও ২০১৪ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায় আওয়ামী লীগকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছিলেন। বিজেপিও ক্ষমতায় আসার পর দ্রুত বুঝে উঠেছিল, বাংলাদেশে একটি তাবেদার সরকার ভারতীয় শাসকশ্রেণী, ব্যবসায়ী ও কর্পোরেটদের জন্য লাভজনক। তাই তারা দ্রুত আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করতে শুরু করেছিল। ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যাতে জিতে আসে সেজন্য সম্ভব সবরকম ভূমিকা তারা পালন করেছে। আওয়ামী লীগকে জেতানোর জন্য তারা তাদের সব শক্তি, ক্ষমতা ও কৌশল কাজে লাগিয়েছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন পার করতে আওয়ামী লীগকে তারা নজিরবিহীন সহযোগিতা করেছে।

এবার অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগে থেকে কথা বলতে শুরু করেছিল। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছিল, তাদের চাপে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভাল একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ভারত প্রথমে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছিল, যাতে তাদের প্রভাবাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে ২০০৮ সালের মতো করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে পারে। পরে সেদিকে সুবিধা করতে না পেরে তারা লোক দেখানো নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে শুরু করে। এর মধ্য দিয়ে তারা তিনটি কাজ করেছিল- ১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে তারা কতদূর যাবে সেটি ভারত নিরূপন করেছিল।

২. নানা প্রচার-প্রপাগান্ডার মাধ্যমে বিএনপিকে বিভ্রান্ত করে দলটির ঘনিষ্ট হয়ে বুঝতে চেষ্টা করেছিল বিএনপি কতদূর যাবে। একধরনের আলাপ-আলোচনা করে বিএনপিকে দিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একাধিক বিবৃতিও দেওয়াতে পেরেছিল।

৩. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাতে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার বাস্তবায়ন করতে না পারে সেজন্য বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটির ভেতর বিভেদ তৈরি করে নিজেদের অ্যাসেট ও এলিমেন্ট ব্যবহার করে উদ্যোগগুলোতে স্যাবোটাজ ও ভণ্ডুল করে দিয়েছিল।

৪. নির্বাচন ঘনিয়ে আসার আগে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো সুরাহা হলো না তখন তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের পরিকল্পনার ভেতর আনতে বাধ্য করেছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত ভারতীয় পরিকল্পনাই সফল হয়ে যায়। এ দফা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনে বাংলাদেশে ভারত তার প্রভাব ও আধিপত্য আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে আরও বাড়িয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশের কাছ থেকে তাদের যা পাওয়ার তা তো পেয়েছেই। এবার পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশকে নিজেদের অধীনে নিয়ে আসতে পেরেছে। আরও স্পর্শকাতর ও কৌশলগত ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের নীতির অধীনেই কাজ করবে বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান বলে দিচ্ছে, ভারত যা বলছে বাংলাদেশ তা-ই করছে।

এই দফা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার জন্য দলটি ভারতের শাসকশ্রেণী বিশেষ করে বিজেপির প্রতি কৃতজ্ঞ। তারা এরই মধ্যে আদানীসহ ভারতীয় কর্পোরেটদের মাধ্যমে ভারতের এই অবদানের ঋণ পরিশোধ করতে শুরু করেছে। কিন্তু অর্থনৈতিক সুবিধাই মূল কথা নয়। বিজেপিকে এবার নির্বাচনে জিতে আসতে হবে। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে সেটি বিজেপিকে বড় মাইলেজ দিতে পারে। কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করতে অর্থাৎ নির্বাচনে বিজেপিকে জিততে সরাসরি সহযোগিতা করতে সরকার কী করতে পারে?

সরকার বাংলাদেশে ধর্মীয় অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে। এর লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি রমজানের শুরু থেকে। সরকারের পক্ষ থেকে সাশ্রয়ের নামে ঐতিহ্যবাহী ইফতার মাহফিল নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে গরুর মাংস রান্না বন্ধ করা হচ্ছে। গরুর মাংসের দাম ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়িয়ে রাখা হচ্ছে। খেজুরকে দুর্মূল্যের বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইফতার মাহফিল বন্ধ করার নোটিশ দেওয়া হচ্ছে। রমজান নিয়ে আলোচনায় হামলা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হচ্ছে। এ ধরনের উদ্যোগ আরও নেওয়া হবে। এগুলো স্পষ্টভাবে মুসলিম সেন্টিমেন্টকে উস্কে দেওয়ার জন্যই করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে মানুষ মাঠে নামলেই নির্বাচনের আগে বিজেপির সুবিধা। আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশে ভারতীয় স্বার্থ দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো, তাদের নানা উপাদানগুলো নির্বাচনের আগে এ ধরনের আরও নানা কাজ করবে। এরই মধ্যে তারা উস্কানিমূলক নানা কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে।

নির্বাচনে জিতে আসা ছাড়াও তাদের আরেকটি টার্গেট আছে। সেটি হলো, নির্বাচনের পর বাংলাদেশে তুমুল জনপ্রিয় হওয়া ভারতীয় পণ্য বর্জন ও ইন্ডিয়া আউট কর্মসূচিকে স্যাবোটাজ করা। এই কর্মসূচি এরই মধ্যে ভারতীয়দের কাবু করে ফেলেছে। তাই, এদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তারা সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় কার্ড খেলতে চায়। ভারতীয় পণ্য বর্জনের কর্মসূচি নরেন্দ্র মোদীকে বিপদে ফেলেছে, কিন্তু সাম্প্রদায়িক উস্কানি থেকে কর্মসূচি এলে তা তাকে সুবিধা দেবে।

ভারতীয়দের এই ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশের মানুষকে অদৃশ্য আন্দোলন হিসেবে কার্যকর ও ধন্বন্তরী ভারতীয় পণ্য বর্জন কর্মসূচিই অব্যাহত রাখতে হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here