এবার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লড়াই

0
58

মাহমুদুর রহমান

৭ জানুয়ারীর “ডামি নির্বাচন” প্রমাণ করে দিয়েছে, কথিত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে দিল্লির উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। ভারতীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন লেখাতে ওই দেশের সব বিখ্যাত সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছেন যে, বাংলাদেশের সর্বশেষ নির্বাচনী তামাশায় গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানও বজায় রাখা হয় নাই এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ একদলীয় ভোট বর্জন করেছে। শামসুল হুদা (২০০৮), রকিব(২০১৪) এবং নুরুল হুদার (২০১৮) মতই ভারত ও হাসিনার সেবাদাস হাবিবুল আউয়াল কমিশন (২০২৪) ভোট প্রদানের হার ৪১ শতাংশ দেখালেও প্রকৃত ভোট যে ১০ শতাংশেরও নীচে ছিল, সেই তথ্যের উল্লেখও প্রতিটি সংবাদে রয়েছে। এই সব ভারতীয় লেখক, সাংবাদিকরা নির্বাচনের নামে নির্লজ্জ তামাশার কথা স্বীকার করে নিয়ে এটাও উল্লেখ করেছেন যে, দিল্লির ইচ্ছানুসারেই বাংলাদেশে সব কিছু ঘটছে। অর্থাৎ, দিল্লির হিন্দুত্ববাদি শাসকরা চেয়েছে তাই “ডামি নির্বাচন” সম্পন্ন হয়েছে, জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে, এবং শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদি শাসন বাংলাদেশে অব্যাহত আছে। সর্বদা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফেরি করা ভারতের দালাল গোষ্ঠী গত পনেরো বছরে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব দিল্লির চরণতলে সর্বতোভাবে বিসর্জন দিয়েছে। কাজেই, প্রভু ভারতের নির্দেশেই বাংলাদেশ আজ পরিচালিত হচ্ছে সেই সত্য ভারতীয়দের রাখঢাখ করে বলার আর প্রয়োজন নাই।

অনেকেই সঙ্গতভাবে প্রশ্ন করে থাকেন যে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি কি আদৌ স্বাধীন হয়েছিল? বর্তমান প্রজন্মের জানার জন্য কিছুটা ইতিহাস বর্ণনা করা আবশ্যক। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর লজ্জাকর আত্মসমর্পণের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কিছু সময়ের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনস্ত হয় এবং বিপুল পরিমানে সম্পদ ভারতে পাচার করা হয়। তারপর জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে ভারত থেকে নজরুল-তাজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকার দেশে ফিরলে দিল্লি সমর্থিত নতজানু সরকারের শাসন শুরু হয় যা কিনা, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশের সফল অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব নিহত হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। বাকশাল পতন পরবর্তী ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ছয় বছর বাংলাদেশ প্রথমবারের মত প্রকৃত অর্থে স্বাধীন ছিল। ১৯৮১ সালের ৩০ মে তারিখে সেনাবাহিনীর ভারতপন্থী অংশের অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট জিয়া চট্টগ্রামে নিহত হলে ভারত আবার বাংলাদেশের দন্ডমুন্ডের কর্তা সেজে বসে। ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত স্বৈরশাসক এরশাদ দিল্লির কৃপায় এবং শেখ হাসিনার সমর্থনে ঢাকার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে। হাসিনার পর এরশাদ ভারতের দুই নম্বর গুরুত্বপূর্ণ দালালে পরিণত হয়। এরশাদের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে সেই দালালির দায়িত্ব প্রথমে রওশন এরশাদ গ্রহণ করবার পর এখন জি এম কাদের নিয়েছে। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর পনেরো বছরের গণতান্ত্রিক শাসনকালে বাংলাদেশের জনগণ দ্বিতীয়বার স্বাধীনতার স্বাদ পায়। এই পনেরো বছরের মধ্যে অবশ্য শেখ হাসিনার পাঁচ বছরের শাসনকালও অন্তর্ভূক্ত ছিল।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ভারতীয় গোয়েন্দাদের দ্বারা পরিচালিত দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও, এক প্রকার জনভীতি ও ভূরাজনৈতিক কারণে ভারত বাংলাদেশকে বর্তমানের মত একেবারে কুক্ষিগত করা থেকে বিরত থাকে। তৎকালিন সময়ে দেশের অধিকাংশ জনগণের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং দেশপ্রেম সাহসিকতার সঙ্গে জাগরুক থাকায় শেখ হাসিনার মত হিন্দুত্ববাদের এজেন্টকেও দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য মাথায় হিজাব দিতে হয়েছিল, ঘন ঘন হজ্ব এবং ওমরাহ পালন করতে হয়েছিল। শেখ হাসিনার পক্ষে সেই সময় দিল্লির ইচ্ছানুসারে কোন তথাকথিত “আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল” গঠন করে ইসলামপন্থী দলসমূহের নেতাদের এবং ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের নায়কদের ফাঁসিতে ঝুলানো সম্ভব হয় নাই। তাকে এবং ভারতকে উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। তবে তখন থেকেই সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র” এর এজেন্টদের অনুপ্রবেশ ঘটানো হতে থাকে যার ফলে ২০০৭ সালে এক এগারোর সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে কোন ভারতীয় সামরিক অভিযান ছাড়াই ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশকে দখল করে নেয়া সম্ভব হয়েছে।

সামরিক বাহিনীতে ভারতীয় এজেন্ট অনুপ্রবেশের উদাহরণ হিসেবে মেজর জেনারেল (অব:) মাসুদের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর ভাইয়ের সঙ্গে আত্মীয়তার সুযোগ নিয়ে সেনা বাহিনীর উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকে বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ভাই মরহুম সাইদ ইস্কান্দারের ভায়রা মেজর জেনারেল মাসুদ (এক এগারোর অভ্যুত্থানকালিন সেনাবাহিনীর ৯ম ডিভিশন প্রধান এবং অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় প্রধান কুশিলব, বর্তমানে শেখ হাসিনা মনোনিত ডামি সংসদের সদস্য এবং ভারতীয় দালাল জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য) যে বরাবর ভারতের নির্দেশ পালন করে গেছে সেটা এখন জনগণের কাছে প্রমাণিত হয়েছে। অবশ্য, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে দখলে নেয়ার অনেক আগে থেকেই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এ দেশে হিন্দুত্ববাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আরম্ভ হয়েছিল। বাঙ্গালী মুসলমানের বিরুদ্ধে পরিচালিত ভারতের সেই বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে দূর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশের অধিকাংশ মিডিয়া, সাহিত্য ও নাট্যকর্মী এবং সুশীল সমাজ তাদের চরিত্রগত ইসলামবিদ্বেষের কারণে ও ভারত থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণের বিনিময়ে দেশবিরোধী, পঞ্চম বাহিনীর ভূমিকা পালন করেছে। মাহফুজ আনাম, মতিউর রহমান, শ্যামল দত্ত, সৈয়দ সামসুল হক, জাফর ইকবাল, আসাদুজ্জামান নুর, সৈয়দ হাসান ইমাম, রামেন্দু মজুমদার, রেহমান সোবহান, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য, সুলতানা কামাল চক্রবর্তী, এবং অন্যান্যরা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে হিন্দুত্ববাদি আগ্রাসনের রাস্তা তৈরী করেছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় ভুটান একমাত্র দেশ যাকে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অন্তে, ১৯৪৮ সালেই ভারত রীতিমত চুক্তি করে অধীনস্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। নেপালকেও একই পদ্ধতিতে ভারত কব্জা করতে চাইলেও সে দেশের তৎকালে ক্ষমতাসীন রাজপরিবার এবং জনগণের মিলিত প্রতিরোধে দিল্লিকে পরাজিত হতে হয়। বৌদ্ধ এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই ভুটানও পঞ্চাশ বছর পর একবিংশ শতাব্দিতে এসে ভারতীয় শৃঙ্খল থেকে মুক্তিলাভের জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ, নব্বই শতাংশ মুসলমান অধ্যুষিত, ১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ একবিংশ শতাব্দিতেই বিনা প্রতিরোধে দিল্লির বশ্যতা স্বীকার করেছে। মালদ্বীপের মাত্র পাঁচ লাখ মুসলমান মোদি সরকারকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সেই দেশ থেকে ১৫ মার্চের মধ্যে সকল ভারতীয় সৈন্য সরিয়ে নেয়ার আল্টিমেটাম দিয়েছে। ভারত মহাসাগরের অতি ক্ষুদ্র দেশটির মন্ত্রিরা নরেন্দ্র মোদিকে ভাঁড়, সন্ত্রাসী এবং ইসরায়েলের চামচা বলে উপহাস করেছে। আর আমরা “গুজরাটের কসাই” নামে বিশ্বে পরিচিত, ভারতীয় মুসলমানের রক্তপিপাসু, সেই ভারতীয় প্রভুর চরণতলে সকল আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে এখন মুক্তির জন্য কাপুরুষের মত ওয়াশিংটনের দিকে তাকিয়ে আছি।

আজ পর্যন্ত কোন জাতি প্রতিরোধ সংগ্রাম ব্যতীত আগ্রাসী বিদেশি শক্তির কাছ থেকে শৃঙ্খলমুক্ত হতে পারে নাই। যুদ্ধ করতে অস্ত্র প্রয়োজন হয়, আবার অস্ত্র ছাড়াও যুদ্ধ হতে পারে। তবে, সশস্ত্র যুদ্ধ যে কোন সংগ্রামের শেষ অধ্যায়। গত প্রায় দুই দশকে ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশ দখল করতে ভারতকে সরাসরি অস্ত্র ব্যবহার করতে হয় নাই। মিরজাফরের উত্তরসূরীরূপে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, বিজিবি এবং পুলিশ ব্যক্তিগত লোভের বশবর্তী হয়ে দিল্লির স্বার্থরক্ষায় নিজেদের জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্র চালিয়েছে। ফলে, কোন ভারতীয় সামরিক আগ্রাসন ছাড়াই আমরা স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নিজ দেশে আজ পরাধীনতার গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছি। আমার ধারনা, পারমানবিক শক্তিধর, কট্টর হিন্দুত্ববাদি, বিশাল এবং আজন্ম আধিপত্যবাদি ভারত ও তাদের এ দেশীয় দালালদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম দীর্ঘমেয়াদী ও কঠিন হবে। তাই আর বিলম্ব না করে প্রতিরোধ যুদ্ধ এখনই আরম্ভ করা উচিৎ। ভারতীয় অর্থনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সেই সংগ্রামের সূচনা হতে পারে। সকল দেশপ্রেমিক শক্তির মধ্যে আলোচনা করে চূড়ান্ত কর্মসূচি প্রণয়ন করা আবশ্যক। সেই কর্মসূচি প্রণয়নে সহায়ক হতে পারে বিবেচনা করে প্রাথমিক লড়াইয়ের একটি সংক্ষিপ্ত প্রস্তাবনা দিয়ে আজকের সম্পাদকীয় শেষ করব:

১) দেশের অভ্যন্তরে ভারতের দালাল গোষ্ঠীর (সামরিক ও বেসামরিক আমলাশ্রেণি, বিচার বিভাগ, ব্যবসায়ী, মিডিয়া, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং সুশীল) একটি তালিকা প্রস্তুত করুন।

২) ভারতীয় পণ্য, যেমন, নারীপুরুষের পোষাক, গহনা, এবং অন্যান্য বিলাস দ্রব্য বর্জন করুন।

৩) ভারতীয় সিনেমা এবং টেলিভিশন চ্যানেল বর্জন করুন। বাংলাদেশে ভারতীয় শিল্পীদের অনুষ্ঠান বয়কট করুন।

৪) বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে ভারতীয় নাগরিকদের পরিবর্তে বাংলাদেশি তরুনদের নিয়োগ দিন। বিদেশি বিশেষজ্ঞদের একান্ত প্রয়োজন হলে ভারত ব্যতীত সার্কভূক্ত অন্যান্য দেশের নাগরিকদের নিয়োগ দিন।

৫) ভারতীয় চ্যানেলে বাংলাদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করুন।

৬) কেনাকাটা করতে অথবা বেড়ানোর উদ্দেশ্যে ধনবানরা ভারত গমন বন্ধ করুন। আপনারা দেশের শত্রুকে সহায়তা করছেন।

৭) যতটা সম্ভব নিজের দেশে চিকিৎসা নিন। অধিকতর চিকিৎসার প্রয়োজনে ভারতের পরিবর্তে কাছের অন্যান্য দেশে যান।

৮) বাংলাদেশের হাসপাতালসমূহে সেবার মান বৃদ্ধি করুন, দক্ষতা বাড়ান এবং চিকিৎসার ব্যয় কমান।

৯) বাংলাদেশে ভারতের চিহ্নিত দালাল শিল্প গোষ্ঠীসমূহের প্রস্তুতকৃত পণ্য ও সেবা কেনা বন্ধ করুন।

১০) ভারতের দালাল মিডিয়াসমূহকে বয়কট করুন। এই সব প্রতিষ্ঠানের পত্রিকা কিনবেন না, টেলিভিশন দেখবেন না।

লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ
২৩/০১/২০২৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here