একজন বললেন ওকে গুম করা বা মেরে ফেলা যাবে না : সাঈদ ইকবাল টিটু

0
88
গাড়িতে তুলেই চোখ বেঁধে ফেললো। এরপর পেছন দিক দিয়ে শক্ত করে হাত বাঁধলো, পা বাঁধলো। মিনিট দশেক গাড়ি চলার পর আমাকে আড়কোলে করে কোনো একটা কক্ষে নিয়ে গেল। শক্ত মেঝের ওপর চিৎ করে শুইয়ে দিল। এভাবে মিনিট পাঁচেক; হঠাৎ পরনের কাপড় খুলে ফেললো। পা দুটো শক্ত রশি দিয়ে বেঁধে উপরের দিকে টান টান করে ঝুলিয়ে দিল। শুরু হলো নির্যাতন। শক্ত কোনো লঠি দিয়ে কোমর থেকে পা পর্যন্ত পেটাতে থাকলো। পায়ের তালুতেও মারলো। ঘন্টা খানেক ব্যথা অনুভব করতে পেরেছি। নির্যাতনে কিছুক্ষন পর পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। তখনই বালতি ভর্তি পানি ঢেলে দিচ্ছিল। এক দুই মিনিট বিরতি দিয়ে রাত নয় টা থেকে ভোর সাড়ে চার টা পর্যন্ত এক টানা পেটালো। পরে শরীরের কোথাও কোনো অনুভুতি ছিল না। পুরো শরীর ফেটে গিয়েছিল। শুধুই ব্যথা। চোখ বাঁধা ছিল, আঘাতের শব্দই শুনেছি। কারো মুখ দেখিনি। কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক সাঈদ ইকবাল মাহমুদ টিটু।
১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারী। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিনের জেলা ভোলার চরফ্যশন উপজেলায় জন্ম। স্কুল শিক্ষক বাবা তাহেরুল আবেদীন ছিলেন থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। শৈশবে বাবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অনুপ্রানীত হয়েই জাতীয়তাবাদী আদর্শে ঝুঁকে পড়েন। তবে, ফুফাতো বোনের স্বামী ভোলা জেলা বিএনপির তৎকালীন সভাপতি এডভোকেট আমিনুল একরাম (১৯৭৯ ও ৯১ সালে ভোলা-৪ আসন থেকে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য প্রাথী ছিলেন) এর সভা সমাবেশে মিছিল করতে করতেই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। মূলত বাবার রাজনৈতিক সহকর্মীদের সাথে ১৯৮৭-৮৮ সালে স্বৈরাচার বিরোধী বহু মিছিল করেছেন শৈশবেই। এর পর ১৯৯১ সালে বরিশালের বিএম কলেজে পড়াকালে সরসরি ছাত্র দলের মাঠের রাজনীতি যুক্ত হন। ১৯৯৩-৯৪ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে স্নাতকে ভর্তি হন লোকপ্রশাসন বিষয়ে। পড়াশোনার সাথে সমান তালে চলে ক্যম্পাস রাজনীতি। ১৯৯৮ সালে এফ রহমান হল শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৯৯ সালে সোহেল-পিন্টু কমিটির কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর পিন্টু-লাল্টু কমিটির যোগাযোগ বিষয়ক সম্পাদক হন। ২০০২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক এবং পর পর লাল্টু-হেলাল কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর একটু বিরতির পর যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মাঠে সক্রিয় আছেন। রাজনৈতিক জীবনে বহুবার মামলা হামলা জেল জুলুম বরণ করেছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক নির্যাতন এবং ভোগান্তির নানান দিক নিয়ে কথা বলেছেন সাঈদ ইকবাল মাহমুদ টিটু।
ছাত্র রাজনীতির নানান পর্যায়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন, কতবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন, কারা বরণ করেছেন?
সাঈদ ইকবাল টিটু: বহুবার আটক হয়েছি। থানা থেকে ছাড়া পেয়েছি। আবার রাস্তায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছি। সে হিসাব কখনো করা হয়নি। তবে দু’একবারের নির্যাতন জীবনকে হুমকিতে ফেলেছে। আমি মনে করি রাজনীতিতো আর হিসাব করে হয় না। এখানে ত্যাগই বেশি করতে হয়।
জীবনকে হুমকিতে ফেলেছে এমন নির্যাতন হয়েছে? পরিস্থিতি কেমন ছিল?
সাঈদ ইকবাল টিটু: ২০১০ সালের ২ এপ্রিল। সন্ধ্যার পর, রাত সাড়ে আটটার দিকে ফকিরাপুল প্রবাস হোটেলের পাশের একটি রেস্টুরেন্টে বসে রাজনৈতিক বন্ধু-সহকর্মীদের সঙ্গে গল্প করছিলাম। এক পর্যায়ে নয়টার দিকে একটি ফোন কল রিসিভ করার জন্য রেস্টুরেন্টের সামনে বের হই। ফোনে কথা বলছিলাম। হঠাৎ পেছন দিক দিয়ে দু’জন ব্যাক্তি ঝাপটে ধরে। পাশেই গেট খুলে রাখা একটি সাদা রং-এর মাইক্রোবাসে তুলে ফেলে। গাড়ির ভেতরে আরো দু’জন বসা ছিল। সিটের ওপর চিৎকরে ফেলে দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে। পেছন দিক দিয়ে প্লাস্টিকের রশি দিয়ে হাত বেঁধে ফেলে। মাথার পেছন দিক দিয়ে পিস্তলের বাট দিয়ে আঘাত করতে থাকে। একটু নড়াচড়া করলেই আবারো মেরুদন্ডের ওপর পিস্তলের বাট দিয়ে আঘাত করে। চোখ বাঁধা, তাই কিছুই দেখতে পারছিলাম না। দু’তিন মিনিট পর চুপ করে বসে রইলাম। গাড়ি চলতে শুরু করলো। কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কিছুই টের পাচ্ছিলাম না। রেস্টুরেন্টে থাকা অপর বন্ধু-সহকর্মীরা কিছুই টের পায়নি। কেউ এই ঘটনার কথা আমার সহকর্মীদের বলেছে কি না তাও জানি না। দশ মিনিট গাড়ি চললো। গাড়ির ভেতরে যারা আমাকে তুলে নিল, তারাও কোনো কথা বলছিল না। বুঝতে পারছিলাম না। কোথায় নেয়া হচ্ছে। হঠাৎ থেমে গেল। গাড়ি থেকে নামানো হলো, কোলে করে।
যারা নিয়ে গেল, তারা আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেনি?
সাঈদ ইকবাল টিটু: না। সবাই চুপ। আমিও কিছুটা ভয়ে ছিলাম। আতঙ্ক কাজ করছিল। আর নড়াচড়া করলেও পিস্তলের বাট দিয়ে মাথার পেছনে ও মেরুদন্ডে আঘাত করছিল। তাই আমিও চুপচাপ বসে রইলাম।
কোথায় নিয়ে গেল?
সাঈদ ইকবাল টিটু: আমার হাত-পা-চোখ সবই বাঁধা। দু’দিক দিয়ে দু’জন চেপে ধরে আছে। তাই কিছুই বলতে পারছি না। শুধু এতটুকু বুঝতে পারলাম; গাড়ি থামার পর যে কক্ষে রাখলো, সেটি নিচের তলায় ছিল।
সেখানে নিয়ে কী করলো?
সাঈদ ইকবাল টিটু: চার জন লোক আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে ওই কক্ষে একটি চেয়ারে বসিয়ে দিল। এরপর অন্তত ৭-৮ জন লোক আমাকে লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করলো। কেউ কোনো কথা বলেনি। আমি চিৎকার দিতেও পারছিলাম না। অচেতন হয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। শুধু টের পাচ্ছিলাম, কেউ একজন হাত-পা খুলে দিল। আমার পরনের প্যন্ট এবং গায়ের টি-শার্ট খুলে নিল। প্রচ- পিপাশায় গলা ফেটে যাচ্ছিল। মুখের ওপর বালতি ভর্তি পানি ঢেলে দিল। নাক দিয়ে পানি মুখের ভেতরে চলে আসলো। সেই পানিতেই কিছুটা তেষ্টা মিটল। তখনো আমার চোখ বাঁধা ছিল। কিছুই দেখছি না।
এর পর কী?
সাঈদ ইকবাল টিটু: দু’তিন মিনিট বিরতি দিয়ে আবারো উলঙ্গ অবস্থায় শক্ত প্লাস্টিকের রশি দিয়ে হাত-পা বাঁধলো। এবার পা দুটো উঁচু করে কিছু একটার সাথে আমাকে ঝুলিয়ে দিল। শুধু ঘাড় মাটির সাথে লেগে ছিল। এবার পায়ের পাতায় পেটাতে শুরু করলো। মনে হচ্ছিল এই বুঝি প্রাণ বেড়িয়ে যাবে। কোমর থেকে পায়ের পাতা ইঞ্চি ইঞ্চি করে পেটালো। পিঠে, কোমড়ে শক্ত বুটের লাথি। হাতের আঙ্গুল গুলো উল্টো করে চাপ দিচ্ছিল। বিশ মিনিট-ত্রিশ মিনিট পর পরই মুখে পানি ছুড়ে মারা হচ্ছিল। আবার মাথায় শক্ত গামছার মতো পেচানো কাপড় দিয়ে শক্ত করে জোরে চাপ দিচ্ছিল। দুই কানসহ মাথায় মারছিল। মাথার পেছন দিক দিয়ে শক্ত লাঠি দিয়েও আঘাত করেছে বহুবার। আমার চোয়ালগুলো শক্ত হয়ে আটকে গেছিল। চোয়াল নেড়ে কথা বলার মতো শক্তিও পাচ্ছিলাম না। ব্যথায় দাঁতগুলো টনটন করছিল। এর সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফেটে রক্ত ঝরছিল। কি পরিমান রক্ত ঝরেছে, তা বলতে পারবো না। শক্ত লাঠি দিয়ে মারার পর শরীর যখন হীম হয়ে গেল, তখন প্লাস্টিকের পাইপের মধ্যে জেল জাতীয় কিছু ঢুকিয়ে, সেই লাঠি দিয়ে পিঠে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে লাগাতার মেরেছে।
একটানা মারছিল? কিছু বলেনি?
সাঈদ ইকবাল টিটু: অশ্লীল ভাষায় গালাগাল, পেটানো আর শরীরের সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্থানগুলোতেও আঘাত করছিল। এছাড়াও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অমানবিক নির্যাতনের আরো যা যা আমরা শুনি, সবই করেছে। যা আমি মুখেও আনতে পারবো না, বা ভাবতেও পারিনা।
সেটা কি? কেমন ছিল সেই নির্যাতনের ধরণ?
সাঈদ ইকবাল টিটু: আজও মনে আসলে লজ্জা হয়, ঘৃণা হয়, কষ্ট হয়। সুস্থ মানুষ যতটুকু ভাবতে পারে তার চেয়েও বেশি মধ্যযুগীয় নির্যাতন করেছে; যা আমি বলতে চাই না। বা কোনো দিন বলতে পারবোও না। তবে, এতটুকু বলি, সেই ক্ষত কাটিয়ে উঠতে জেলখানায় আমার অনেক দিন সময় লেগেছে। আমি একা হেটে টয়লেটেও যেতে পারতাম না।
কতক্ষন নির্যাতন চললো?
সাঈদ ইকবাল টিটু: ভোর পর্যন্ত পা উপরের ঝুলিয়ে টানা পিটিয়েছে। হঠাৎ ভোরের দিকে কেউ একজন এসে বললো, না, উপর থেকে ফোন করেছে। ওকে গুম করা বা মেরে ফেলা যাবে না। পুলিশে দিয়ে দিতে হবে। এর পর আমাকে নামানো হলো। মাটিতে শুইয়ে দিল। আমি অনেকটাই অচেতন। শরীরের সবখানেই ব্যথা। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কথা বলার শক্তিও আমার ছিল না। হাত-পা চোখ সরবই বাঁধা। শুধু শুনছিলাম। আমাকে মেঝেতে শুইয়ে রাখা হলো।
এর পর কী হলো?
সাঈদ ইকবাল টিটু: একজন আবারো হাত-পা খুলে দিল। কাপড় পড়ানো হলো। জুতা পরানোর মতো পরিস্থিতি ছিল না। কারণ দু’পাই ফেটে গেছে। পা জুতার মধ্যে ঢুকছিল না। তাই খালি পায়েই রাখা হলো। আবারো হাত পা বেঁধে চার জন আমাকে কোলে নিয়ে গাড়িতে তোলা হলো। সিটের ওপর চিৎ হয়ে শুইয়ে, মিনিট দশেক গাড়ি চললো। আবারো কোলে করে একটি কক্ষে নিয়ে মেঝেতে ফেলে দিল। তারা চলে গেল।
কেথায় নিয়ে যাওয়া হলো টের পেয়েছেন?
সাঈদ ইকবাল টিটু: হ্যঁ। ওরা চলে যাওয়ার দশ মিনিট পর একজন লোক আসলো। তিনি এসেই আরেকজনকে ডাকলেন, হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিতে বললেন। সেই লোক হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে চলে গেল। এর মিনিট পাঁচেক পর আর একজন এসে আমার চোখ খুলে দিল। সামনে দেখছিলাম, গাল ভর্তি দাড়ি র‌্যাবের পোশাক পরিহিত একজন। দেখে কর্মকর্তাই মনে হয়েছিল। র‌্যাব আপনাকে মারেনি বা তুলেও আনেনি জানিয়ে তিনি বলছিলেন, “আপনিতো প্রচণ্ড পিপাসার্ত। কিন্তু আপনার যা অবস্থা আপনাকেতো পানি দেয়া যাবে না। আপনার শরীর কলাপ্স করবে। এর পরও আমি আপনাকে পানির বোতলের কর্কে করে একটু একটু পানি দিচ্ছি।” এভাবে অন্তত পাঁচ মিনিট বসে তিনি আমাকে ৪-৫ বার ওই কর্কেই পানি মুখে দিলেন। এরই মধ্যে র‌্যাবের ৭-৮ জনের একটি টিম এসে আমাকে নিয়ে যেতে হবে বলে কোলে নিয়ে আবারো গাড়িতে তুললেন।
কোথায় নিয়ে গেল তারা?
সাঈদ ইকবাল টিটু: গাড়িতে আমাকে তারা ৩ জন কোলের ওপর শুইয়ে নিয়ে বেরিয়ে পরলো। তখন ভোর হচ্ছে। গুলিস্তান আউটার স্টেডিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। একটি সিএনজি অটোরিক্সা দাঁড় করালো। আমাকে আবারো গাড়ি থেকে নামানো চেষ্টা করলো ওরা। কিন্তু শরীরের অবস্থা দেখে তা পারলো না। র‌্যাবের গাড়ির সামনের সিটে বসা কর্মকর্তা বললেন, নামানোর দরকার নেই। গাড়িতেই সারো। আমার পাশে থাকা র‌্যাবের সদস্যদের মধ্যে একজন গুলির বক্স এবং বিভিন্ন ধরনের কিছু মাদক দ্রব্য বের করে ওই সিএনজি চালককে বললো, “তোমার সিএনজিতে করে এই লোক গুলি এবং মাদক নিয়ে যাচ্ছিল, চেকপোস্টের তল্লাশীতে আমরা (র‌্যাব) আটক এবং উদ্ধার করেছি, তুমি দেখেছ এবং এই ঘটনার স্বাক্ষী”। সিএনজি চালক খুব অনুরোধ করলো তাকে (সিএনজি চালক) এ ঘটনায় না জড়ানোর জন্য। কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না। সিএনজির নাম্বার, চালকের লাইসেন্স সব নিয়ে নিল। একই সময়ে পাশে আউটার স্টেডিয়ামের ফুটপাতে ঘুমানো ছিন্নমূল দু’জনকে ডেকে তাদেরও স্বাক্ষী করা হলো। এর পর আবারো টিকাটুলি র‌্যাবের ক্যম্পে নিয়ে যাওয়া হলো।
এর পর কী আপনাকে আবারো নির্যাতন করা হলো?
সাঈদ ইকবাল টিটু: না। এর পর আবারো র‌্যাব ক্যম্পের গারদের মধ্যে কয়েকটি কম্বল বিছিয়ে সুইয়ে রাখা হলো। এসময় ওই গারদের মধ্যে আরো বেশ কয়েক জন আটক ছিল। তাদেরকে কয়েকটি ব্যথা নাশক (মুভ) মলম ধরিয়ে দিয়ে র‌্যাব সদস্যরা আমার শমস্ত শরীরে মালিশ করতে বলল, অন্য আটকদের। তাদের শরীরেরও বিভিন্ন অংশ ফেটে রক্ত ঝরছিল। কিন্তু আমারা শরীরের অবস্থা এতই খরাপ ছিল, যে আমি বসতে বা শুয়ে থাকতেও পারছিলাম না। সকাল সাতটার দিকে আমাকে পাউরুটি, ডিম, সবজি এগুলো খেতে দেয়া হলো।
এখানেই কী শেষ?
সাঈদ ইকবাল টিটু: এর পর সকাল দশটার দিকে আমাকে র‌্যাবের সিইওর কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। চারজন র‌্যাব সদস্য আমাকে কোলে করে নিয়ে গেল। সিইও’র কক্ষের একটি সোফায় আমাকে শুইয়ে দেয়া হলো। সিইও সাহেব আমাকে বললেন, আপনার ওপর ওদের এত ক্ষোভ কেন? প্রশাসনের ওপর থেকে যদি অনুরোধ করা না হতো, ওরাতো আপনাকে মেরেই ফেলতো। তিনি বললেন, “সরি আমরা(র‌্যাব) কিন্তু আপনাকে কিছু করিনি, মারিনি, শুধু হুকুম মতো কাজ করছি।”
“ওরা” বলতে র‌্যাব কাদেরকে বুঝিয়েছে?
সাঈদ ইকবাল টিটু: তা আমাকে বলেনি। আর আমিও ব্যথায় এতটাই কাতর ছিলাম, যে সে বিষয়ে জানার মতো আগ্রহ বা ইচ্ছা কোনোটাই ছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল, কখন আমাকে হাসপাতাল বা কোর্টের মাধ্যমে এখান থেকে সরাবে। ওই সময় গুলি এবং মাদকসহ আমার ছবি তোলে।
থানায় নেয়ার পর কী হলো?
সাঈদ ইকবাল টিটু: সোয়া ১২টার দিকে থানায় নেয়ার পর পল্টন থানার ওসি আমার শারীরিক অবস্থা দেখে রাখতে চায়নি। কিন্তু র‌্যাবের সিইওর ফোনে থানার গেইট থেকেই দু’জন পুলিশের সদস্য আমাকে নিয়ে পুলিশ হাসপাতালে যায়। হাসপাতালের ডাক্তার আমাকে দেখে বললেন, “এর শরীরে কিছু আছে? একে চিকিৎসা দেব কোথায়?” যদিও এর পর শুধু দ্রুত ব্যথা কমানোর ইঞ্জেকশান দিল, আর ব্যথা নাশক মলম মালিশ করতে বলে ছেড়ে দিল। থানায় গিয়ে দেখলাম সেখানে বিএনপিসহ সহযোগী অংগ সংগঠনের বহু নেতা-কর্মীতে গারদ টইটম্বুর। আমার অবস্থা দেখে তারা আমার শরীরে ম্যসেজ করা শুরু করলো। পরের দিন আমাকে আদালতে পাঠালো পুলিশ।
আদালত এ অবস্থা দেখে কী মন্তব্য করলো?
সাঈদ ইকবাল টিটু: আদালতে তোলার পর পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড চেয়েছিল। কিন্তু শরীরের অবস্থা দেখে আদলত রিমান্ড মঞ্জুর করলো না। শুধু কারাগারের গেইটে একদিনের জিজ্ঞাসাবাদের অনুমোদন দিল। একই সঙ্গে কারাগারের হাসপাতালে ভর্তি করে উন্নত চিকিৎসা দেয়ার নির্দেশ দিল।
চিকিৎসা কেমন পেয়েছিলেন?
সাঈদ ইকবাল টিটু: না, কোনো চিকিৎসা পাইনি। কারাগারের আমদানীতে একদিন রাখার পর আমাকে ওয়ার্ডে দিয়ে দিল। আদালতের নির্দেশ থাকার পরও কারা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি। আমি তখনো হাটতে পারছিলাম না। অন্য বন্দীরা আমাকে কোলে করে টয়লেট, গোসল করাতো। এমনকি খাবারও আমি তুলে খেতে পারতাম না। ওই মুভ মলম আর প্যরাসিটামল দিয়েই ব্যথা কিছুটা কমেছিল। আর কোনো চিকিৎসাই পাইনি। দেড় মাস পর জামিনে মুক্তি পাই।
এর পর চিকিৎসা করিয়েছিলেন?
সাঈদ ইকবাল টিটু: করিয়েছি। কিন্তু ডাক্তার তখনই বলেছিল, অনেক দেরি হয়ে গেছে। যেহেতু কোন হাড় ভাঙ্গেনি, তাই টের পাইনি।
এখন কী অবস্থা?
সাঈদ ইকবাল টিটু: ২০১৬ সালের ৯ মার্চ ওই মামলায় হাজিরার জন্য আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অবস্থায় হঠাৎই মাথা ঘুরে পড়ে যাই। আইনজীবী এবং উপস্থিত পরিচিতজনেরা হাসপাতালে নিয়ে যায়। বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসক তখন বললেন, “এটা ছিল দ্বিতীয় এট্যাক”। এর আগে ২০১০ সালের ওই নির্যাতনে প্রথম এ্যটাক হয়েছিল। কোনো চিকিৎসা না হওয়ায় আমার হার্টের নিচের দিকের একটা অংশের সেল (কোষ) শুকিয়ে গেছে। তখনই চিকিৎসা নিতে পারলে সমস্যাটা এতদূর গড়াতো না। এর পর দীর্ঘ চিকিৎসা নেয়ার পর এখন সম্পূর্ণ সুস্থই আছি। তবে, জীবনের ওপর থেকে যে ধকল গেল, সেই ধকলে আমি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ভাবে যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, সে ক্ষতি কাঁটানো সম্ভব না।
আপনার দল এসময় আপনার পাশে ছিল?
সাঈদ ইকবাল টিটু: অবশ্যই পাশে ছিল। আমার রাজনৈতিক বন্ধু-সহকর্মীরা এই সময়টাতে আমার শরীর, মনোবল ঠিক রাখতে নিবিড়ভাবে সাপোর্ট দিয়েছে। ওই ঘটনার পর জেল থেকে বেড়িয়ে আমি দীর্ঘ দিন একধরনের ট্রমায় পড়ে গিয়ে ছিলাম। আমি প্রচন্ড রকমের বইপাগল মানুষ, সেই আমার বই পড়ার ওপর একধরনের অনাগ্রন জন্ম নিয়েছিল। ঘর থেকে বাাইরে বেরুনোর ওপর অনাগ্রহ জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু আমার রাজনৈতিক বন্ধুরা আমাকে দলীয় নানান কর্মকান্ডে নিয়ে আসতো। ধীরে ধীরে আমি স্বাভাবিক হই।
এখন কী অবস্থা?
সাঈদ ইকবাল টিটু: এত কিছুর মধ্যেও আমি দলের সব ধরনের কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিলাম। আন্দোলন সংগ্রামে ছিলাম। ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নারকীয় তাণ্ডবে আবরো নির্যাতনের শিকার হই। দিনভর গুলি, টিআরসেল আর পার্টি অফিস আটকে আবদ্ধ রুমের মধ্যে টিআরসেল নিক্ষেপ করেছে। অন্তত ৫ ঘন্টা এমন অবস্থার পর রাত ৮টার দিকে দলের সিনিয়র নেতাদের সাথে আমিসহ অন্তত ৬’শ নেতা-কর্মীকে আটক করে
পুলিশ। ওই দফায় শারীরিক নির্যাতন কিছুটা কম ছিল। তবে, তিন মাসেরও বেশি কারাভোগ করতে হয়েছে। জামিনে মুক্তি পেয়ে গণতন্ত্রের লড়ায়ের মাঠে ছিলাম; এখনো আছি।
রাজনীতি থেকে কী পেলেন?
সাঈদ ইকবাল টিটু: সেটা হিসেবে সময় আসেনি। এখন আন্দোলনের সময়। তার পরেও অনেক প্রাপ্তি আছে। সব প্রাপ্তি হিসেব করতে নেই। মানুষের অধিকার, দাবি দাওয়া নিয়ে লড়াইয়ে, জয়ের আগে প্রাপ্তির হিসেব করাও ঠিক না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে কী আপনি হতাশ?
সাঈদ ইকবাল টিটু: অবশ্যই না। সব সময় সব জায়গায় রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে হাজির হতে হবে, তা ঠিক নয়। সামাজিক সম্পর্ক বাড়াতে হবে। রাজনৈতিক বিস্তারের জন্য সামজিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে। আমিতো দেখি, সমাজে অধিকাংশ মানুষই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তারা হয়তো প্রতিবাদে সামিল হয় না। কিন্তু পরিস্থিতি সৃষ্টি করাটা রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাজ। আমি সেটা করছি। এবং বিশ্বাস করি এই মানুষেরাই মুক্তির লড়াইয়ে আমাদের পাশে থাকবে। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা যে অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়ছি, সে লড়াই এত সহজ নয়। তবে, লড়াই চালিয়ে যেতে হবে, বিজয় শেষ পর্যন্ত মানুষেরই হবে। আমাদেরই হবে।
অনেক ধরনের সমালোচনা আছে, আপনি অনেক নির্যাতিত হয়েছেন, এর পরেও স্বপ্ন দেখেন?
সাঈদ ইকবাল টিটু: অবশ্যই স্বপ্ন দেখি। আমিইতো বিএনপি, আমার স্বপ্ন মানেই বিএনপির স্বপ্ন। রাজনীতিতে ভোগের চেয়ে ত্যাগের পরিমানই বেশি থাকে। এটা মেনে নিয়েই রাজনীতি করতে হবে।
সূত্রঃ বাংলা আউটলুক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here