‘এটা কোন ডেমোক্রেসি না’, ‘এটা কোন নির্বাচনই না’, ‘ক্ষমতাসীন ও জোটের মধ্যে সিট বন্টন করে নির্বাচন অলরেডি হয়ে গেছে ‘, ‘এটা প্রহসনের নাটক’, ‘এখন মাৎস্যন্যায় চলছে’, ‘এই নির্বাচন স্থগিত করা উচিৎ’ আগামী ৭ই জানুয়ারি হতে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এভাবেই নানা মন্তব্য করেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার, অর্থনীতিবিদ ও মানবাধিকার কর্মীরা।
২০ ডিসেম্বর রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে ‘ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ : নির্বাচন, অর্থনীতি এবং বহিঃসম্পর্ক’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) আয়োজনে সভাপতিত্ব করেন সংস্থার চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী ও সঞ্চালনা করেন নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।
অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমান্ডার (অব) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ আবদুল মজিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)’র বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড. আই. খান পান্না, ও নিউ এইজ সম্পাদক নূরুল কবীর।
গোলটেবিল আলোচনায় আগামী জাতীয় নির্বাচন, বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা, নির্বাচনের ফলে অর্থনীতিতে এবং বাংলাদেশের সাথে বহিঃবিশ্বের সম্পর্কে এর প্রভাব আলোকপাত করা হয়।
৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘মনমত বিরোধী দল ও জোট নিয়ে ক্ষমতাসীনরা আসন বন্টন করে নির্বাচন ইতিমধ্যে করে ফেলছে, এখন আর নির্বাচনের কিছু নেই। প্রবলেম হচ্ছে নির্বাচনের সংজ্ঞা নিয়ে। অনেকে নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণকেই ইনক্লুসিভ নির্বাচন বলতে চাচ্ছেন। ইনক্লুসিভ নির্বাচন মানে প্রতিযোগিতামূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ, যেখানে ক্ষমতাসীনদের অন্য অংশগ্রহণকারীরা চ্যালেঞ্জ করে। এখন তো কোন চ্যালেঞ্জ নেই, ফলাফলও নিশ্চিত, সিট বন্টনের পরও ক্ষমতাসীনদের ২৪০-২৬০ নিশ্চিত থাকবে। এভাবে নির্বাচন হলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে। অলরেডি গলা কেটে ফেলা, হাত কেটে ফেলা, পিটানোর বক্তব্য দেওয় হচ্ছে। এই নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণের পার্সেন্টেজও বিশ্বাস করা যাবে না, আমরা দেখেছি ৫% এর কম ভোটকেও নির্বাচন কমিশন ১৭% দেখিয়েছে পূর্বে।’
নির্বাচনে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ নিয়ে মন্তব্য করেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘ এখন নির্বাচনে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ নিয়ে মন্তব্য করছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা বা প্রতিবেশী দেশের হস্তক্ষেপ হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রতিবেশী দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরাসরি এসে হস্তক্ষেপ করেছেন। গণতন্ত্র ও নির্বাচন যা কিছু আমাদের দেশে জবাবদিহিতা নেই। বড় বড় প্রকল্পে প্রতিবেশী দেশের তুলনায় অনেক বেশি খরচ হচ্ছে, কেন বেশি খরচ হচ্ছে তার উত্তর বা জবাবদিহিতা নেই। আমাদের পররাষ্ট্র নীতি হচ্ছে সবার সাথে বন্ধুত্ব কিন্তু আমরা যে ভাষায় কথা বলছি তাতে পচিমা দেশের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকবে না।’
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমি এটাকে নির্বাচন না বলে বিশেষ নির্বাচনী তৎপরতা বলবো। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ‘পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট’ প্রয়োজন। পূর্বে আমাদের এরকম সংকটে রাজনৈতিক সমঝোতা হয়েছিল এবারও প্রয়োজন নতুন রাজনৈতিক সমঝোতা, না হলে দেশ কঠিন বিপদে পড়বে। আমরা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নিত হতে চাই, সেজন্য স্টাবল প্রতিষ্ঠান থাকতে হয়, অর্থনীতির সুষম বণ্টন থাকতে হয়। এখানে কোন প্রতিষ্ঠান দাড়াচ্ছেন না। ফলে আমাদের উন্নতি সম্ভব নয়৷ তবে আমি আশাবাদী মানুষ। নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য রাজনীতিবিদদের উপর ভরসা রাখতে চাই।
আলোচনায় দেশের জিডিপি ও অর্থনৈতিক নানা সূচক নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিচার্স ইন্সটিটিউট এর পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘ আমরা বিভিন্ন সূচকে ভারতকে ছাড়িয়ে গেলাম, জিডিপি বাড়িয়ে ৭.৫ দেখানো হলো, এতো জিডিপি আসবে কোথা থেকে? এভাবে জিডিপি বা নানা সূচক বাড়িয়ে ন্যারেটিভ তৈরি করা যায় কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয় না, জনগণের অবস্থা খারাপের দিকে যায়। আমাদের আর্থিক খাতের সক্ষমতা নেই সরকারকে সহযোগিতা করার৷ নির্বাচন হয়তো করা যাবে কিন্তু পরবর্তীতে ট্যাকেল করা সম্ভব হবে না। এটি সরকারের জন্যই আত্মঘাতী।
নির্বাচন স্থগিতের দাবি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। আর দেশের গণতন্ত্র নিয়েই প্রশ্ন তোলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, তিনি বলেন স্বাধীন দেশে কোন ফেয়ার নির্বাচনই হয় নাই, এটা কোন ডেমোক্রেসিই না।
আলোচনার সভাপতি ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে মাৎস্যন্যায় হিসেবে মন্তব্য করেন৷ তিনি বলেন, ‘অর্থনীতিতে চলছে ভেল্কিবাজি, জিও পলিটিক্সে একা হয়ে যাচ্ছি, পশ্চিমার সাথে সম্পর্ক শীতল হলে অর্থনীতির উপর চাপ পড়বে। মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলা যায় না, মানবাধিকার লঙ্ঘন করায় আইনশৃঙ্খলা কর্মকর্তাদের উপর স্যাংসন আসছে এটা জাতি হিসেবে লজ্জার। এখন যা চলছে এটা মাৎস্যন্যায়৷