দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন উত্তপ্ত। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফশিল অনুযায়ী ভোটের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। অন্যদিকে ভোট বয়কট করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে টানা কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো।
দেশের রাজনীতিতে সমসাময়িক নানা ইস্যু নিয়ে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মানিক রাইহান বাপ্পী।
যুগান্তর: বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন?
ব্যারিস্টার পার্থ: বর্তমানে রাজনীতি ডেড লকে চলে গেছে। এখন যে আন্দোলন হচ্ছে, সেটি প্রায় এক বছর আগে থেকে শুরু হয়েছে। আমরা ও বিদেশি বন্ধুরা সবসময় একটা ভালো ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চেষ্টা করছিলাম। সেখান থেকে এখন নির্বাচন নিয়ে কী হচ্ছে— এটা সাদাপানির মতো পরিষ্কার। সরকার তো ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে রাজি নয়, সংলাপও করল না। এক কথায়— সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে সরকার এগোচ্ছে না। আবার আরেকটি ২০১৪ ও ২০১৮ নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে সরকার। একই কায়দায় আরেকটি নির্বাচন দেখতে পাবে পুরো দেশ।
যুগান্তর: সুষ্ঠু নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন কতটুকু ভূমিকা পালন করছে?
ব্যারিস্টার পার্থ: নির্বাচন কমিশনকে তো দোষ দিয়ে লাভ নেই। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে নির্বাচন পরিচালনা করা। এটি সাংবিধানিক পোস্ট, তারা সংবিধানের মধ্যে থেকে সব কিছু করবে। তবে সিইসির বেশ কিছু বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে সমালোচনায় এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। যেমন— বিশেষ করে কেউ ইন্তিকাল করেছেন বা করেননি। এ ছাড়া এত কিছু অনিয়ম দৃশ্যমান হওয়া সত্ত্বেও তেমন কোথাও ভোট বাতিল করতে পারেনি ইসি।
আমি মনে করি, রাজনৈতিক সংকট রাজনীতিবিদদেরই সমাধান করতে হবে। এ দেশের গণতন্ত্র রাজনীতিবিদরাই যুদ্ধ করে এনেছেন। আবার রাজনীতিবিদরা ক্ষমতালোভী হওয়ার কারণে গণতন্ত্র চলে গেছে। আবার এসেছে, আবার চলে গেছে। আবারও গণতন্ত্রে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পলিটিশিয়ানদের বসে ঠিক করতে হবে। এ দেশের জনগণকেই ঠিক করতে হবে।
যুগান্তর: ব্যারিস্টার শাহজাহার ওমর ও সৈয়দ একে একরামুজ্জামান জামিন পেয়েই নৌকায় উঠলেন। তাদের জামিন কি আইনি প্রক্রিয়া, না রফাদফা ছিল?
ব্যারিস্টার পার্থ: এটা বুঝার জন্য আইনজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। এটা জনসাধারণও বুঝে। সরকার বরাবরই তাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য জুডিশিয়ারিকে ব্যবহার করে। আওয়ামী লীগ তো প্রথম থেকেই জুডিশিয়ারিকে ব্যবহার করছে। আজকে নতুন না।
যুগান্তর: বিএনপি ভাঙতে, না অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে ব্যারিস্টার শাহজাহানকে নিয়েছে আওয়ামী লীগ?
ব্যারিস্টার পার্থ: শাহজাহান ওমর তো তৃণমূলে যাননি বা অন্য জায়গায় যাননি। তিনি দল পরিবর্তন করেছেন। দল ভাঙেননি। শাহজাহান ওমর যদি তৃণমূলও যেতেন বা দল ভাঙতেন বা বিএনএফে যেতেন, তা হলে বুঝতাম— বিএনপিকে ভাঙতে তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে। মূলত শাহজাহান ওমরের মূল্য আওয়ামী লীগ বুঝতে পেরেছে। এ জন্য উনাকে রাতারাতি জেল থেকে বের করিয়ে নমিনেশন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। অথচ তার নামে একাধিক মামলা। শাহজাহানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করেছে যে, গাড়ি পোড়া মামলা থাকুক অথবা পুলিশ হত্যা মামলা থাকুক, আওয়ামী লীগে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
যুগান্তর: শাহজাহান ওমরের নৌকায় নির্বাচন করাটা কীভাবে দেখেন?
ব্যারিস্টার পার্থ: আমি কীভাবে দেখি সেটি বিষয় না, জনগণ কীভাবে নিচ্ছে, সেটি বিষয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে শাহজাহান ওমর ও মেজর (অব.) ইবরাহিমকে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের ভূমিকা দিয়ে মূল্যায়ন করতে চাই।
সেটার মূল্য আজকের দিনের এমপি-মন্ত্রীর থেকে অনেক বেশি। দুর্ভাগ্যবশত উনারা নিজেদের পজিশন বুঝলেন না। এই বয়সে এসে যদি এমপি হওয়াটাকে অর্জন মনে করেন, তা হলে আমার কিছু বলার নেই।
যুগান্তর: ২০১৪ সালের মতো এবারও বিএনপি ছাড়াই নির্বাচন হচ্ছে। এ নির্বাচনে ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৭টি নিবন্ধিত দল অংশ নিচ্ছে। এ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক বলবেন কিনা?
ব্যারিস্টার পার্থ: খাতাকলমে ২৭ বলুন আর ৪০টি বলুন— এ দেশে ভোট মূলত আওয়ামী লীগ আর বিএনপির। অধিকাংশ ভোটই তাদের। তাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে সেটিকে কোনোভাবেই অংশগ্রহণমূলক বলা যাবে না। খাতাকলমে দেখাতে পারেন, ৪০ দল গেছে বা ৫টা গেছে। বাস্তব সত্য হলো— সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। তা হলে জনগণের মাঝে বিশ্বাস আসবে। যেমনটি ঘটেছিল গত নির্বাচনগুলোতে ভোটাররা কেন্দ্রে আসেনি। মসজিদের মাইকে আহ্বান ও পুলিশ দিয়েও ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের নিয়ে আসতে পারেনি সরকার। কারণ একটিই— মানুষের আগ্রহ থাকছে না। যে ফল মানুষ আগে জেনে যাচ্ছে— কী ফল হবে। সেখানে ভোট নিয়ে মানুষের আগ্রহ থাকবেই না— এটিই স্বাভাবিক।
এবারের নির্বাচনে ভোট কারচুপি করা লাগত না, যেহেতু বিএনপি নেই। তার পরও কারচুপি করবে আওয়ামী লীগ। শুধু বিশ্ববাসীকে দেখানোর জন্য যে, এত পার্সেন্ট ভোট পড়েছে। কিন্তু আমরা দেখতে পাব আসলে কতজন মানুষ ভোট দিতে গেছে?
যুগান্তর: নির্বাচনে ‘ডামি প্রার্থী’— এটি কি আওয়ামী লীগের কৌশল না অসহায়ত্ব?
ব্যারিস্টার পার্থ: কোনো কৌশল নয়, এটা অসহায়ত্ব। শুধু আমেরিকাসহ বিশ্বকে দেখানো যে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া কোনো প্রার্থী নির্বাচিত হয়নি। এ জন্য একসময় বলছে— স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ভোট দিতে হবে। আবার বলছে— নৌকায় ভোট দিতে হবে। একবার ডামি প্রার্থী দাঁড়াও, আবার বলছে— স্বতন্ত্র প্রার্থী সবাই দাঁড়ানো যাবে না। আমরা আবার বাছাই করে নেব। এটাই আওয়ামী লীগের দেউলিয়াত্ব।
আওয়ামী লীগের ধারণা ছিল— বিএনপিকে ভাঙতে পারবে। অথবা বিএনপির সঙ্গে ছোট ছোট দলগুলোকে নির্বাচনে নিয়ে আসতে পারবে এবং সিনিয়র অনেক নেতাকে বিএনপি থেকে সরাতে পারবে। কিন্তু সেখানে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ডামি প্রার্থী দিচ্ছে। যাতে অন্তত্ব ২০ শতাংশ ভোটারও যদি কেন্দ্রে আসে। আমি বিশ্বাস করি এবারও ৫ শতাংশ ভোটার আসবে না।
দুঃখজনক বিষয় হলো— স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে আওয়ামী লীগের মতো একটি বৃহৎ দলকে ডামি প্রার্থী দিতে হচ্ছে। এর চাইতে বড় দুর্ভাগ্যের কিছুই হতে পারে না।
যুগান্তর: যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোসহ গণতান্ত্রিক দেশগুলো সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সরকারকে তাগিদ দিচ্ছে। এর পরও যদি এভাবে নির্বাচন হয়ে যায় দেশে কোনো পড়বে কিনা?
ব্যারিস্টার পার্থ: দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ হবে। বড় ধরনের স্যাংশন আসার সম্ভাবনা আছে। বিশ্বের অনেক দেশ বারবার সতর্ক করছে। তার পরও সরকার যখন পুতুল খেলা নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। নির্বাচনের পর যদি আমেরিকা স্যাংশন দেয়, তা হলে তো সরকারের তরফ থেকে কিছু বলার থাকবে না।
এভাবে নির্বাচন সরকার করলে প্রথমত বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট হবে। স্যাংশন দিলে এলসি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসা ও গার্মেন্টসে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এতে লাখ লাখ শ্রমিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আমরা তো ইমপোর্টনির্ভর দেশ। আমি মনে করি পুরো দেশের ওপর সাংঘাতিক প্রভাব পড়বে।
যুগান্তর: তফশিল ঘোষণার আগে ডোনাল্ড লু তিন দলকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। সেই চিঠিকে সরকার কতটা গুরুত্ব দিয়েছে বলে মনে করেন?
ব্যারিস্টার পার্থ: চিঠিকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি আওয়ামী লীগ। একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে চায়। আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে যে, সংলাপ বা সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে ক্ষমতায় থাকতে পারবে না তারা। আওয়ামী লীগ হেরে যাবে, এটা নিশ্চিত হয়েই তো পুতুল খেলা নির্বাচনের আয়োজন করতে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ জানে, গত দুটি নির্বাচন কীভাবে হয়েছে? তাদের ইমেজ তৈরির কোনো উদ্দেশ্য নেই। তাদের মূল টার্গেট ক্ষমতায় থাকতে হবে। সেখানে ডোনাল্ড লু বা ডোনাল্ড ট্রাম্প চিঠি দিলেও এটা আওয়ামী লীগের কাছে কোনো বিষয়ই না।
যুগান্তর: আপনার দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের প্রস্তাব দেওয়া হলে গ্রহণ করবেন কিনা?
ব্যারিস্টার পার্থ: আমরা গত চার বছর ধরে দল গোছাচ্ছি। ইতোমধ্যে ৪৫ জেলায় কমিটি হয়েছে। ঢাকায় পুরোদমে কাজ চলছে। দলটাকে আরেকটু ভালো করে গুছিয়ে নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে চাই। যারা আসতে চায়। আমরা শুরু থেকে জোটের আন্দোলনের সঙ্গে নেই। আপাতত এ বিষয় নিয়ে মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।
যুগান্তর: আপনার মা বঙ্গবন্ধুর ভাইঝি ও শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বোন। আপনার শ্বশুর ও শ্যালকও বর্তমানে এমপি। আওয়ামী লীগের রাজনীতি না করে আপনি কেন আওয়ামী লীগ বিরোধী অবস্থানে?
ব্যারিস্টার পার্থ: আমি আওয়ামী লীগ বিরোধী নই। তবে সরকারের বিরুদ্ধে। আমি আমার রাজনীতি করি। আমার বাবা জাতীয় পার্টি করতেন। আমি সেটাই করি। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে শ্রদ্ধা করি। একদিকে বঙ্গবন্ধুর কন্যা (শেখ হাসিনা), অন্যদিকে জিয়াউর রহমানের স্ত্রী (খালেদা জিয়া) ও ছেলের দেশের জন্য ব্যাপক অবদান আছে। তবে আমি সংসদে থাকি বা না থাকি জনগণের কথা বলব। আমি মনে করি সম্মানের জায়গায় সম্মান।
যুগান্তর: বর্তমানে খেলোয়াড়, নায়ক-নায়িকা, সরকারি আমলারা পার্লামেন্টের মেম্বার হওয়ার জন্য উদগ্রীব। এটিকে কীভাবে দেখেন?
ব্যরিস্টার পার্থ: পলিটিশিয়ানদের কাছে এটা উইক আর সেফ। কারণ এদের প্রশ্ন করতে পারবে না। কারণ তারা রাজনীতিবিদ না। এদের ওপরে যারা আছেন, তারা সেফ মনে করেন। তাদের একটা নিজস্ব ইমেজ থাকে। যখন দলের ইমেজ কম হয়ে যায়, তখন অন্যদের ইমেজের ওপর ভর করে। সাকিব-ফেরদৌস এরা তো উইক ক্যান্ডিডেট। এরা কোনো দিন সিরিয়াস পলিটিকস করেনি, করতেও পারবে না। তাদের মধ্যে নৈতিকতাও নেই। বিশেষ করে সাকিবের মধ্যে সবকিছু থাকলেও আল্লাহ তাকে নৈতিকতা দেয়নি।
নৈতিকতা থাকলে এ ধরনের কাজে আসে না। কারণ তাদের মধ্যে একটা লোভ কাজ করে যে, বিনাভোটে নির্বাচিত হতে পারব। বেয়াহাদেরও একটা সমাজ থাকে, সেখানেও তারকা থাকে। এখানে তারা তারকা হবে।
যুগান্তর: ছাত্ররাজনীতিকে কীভাবে দেখেন?
ব্যারিস্টার পার্থ: এই অল্প বয়সে যারা রাজনীতি বুঝে না, তাদের রাজনীতিতে ঢোকানো রাজনৈতিক ব্যবহার ছাড়া কিছুই নয়। এই বাচ্চা ছেলেরা যখন রাজনীতিকে ব্যবহারসহ বিভিন্ন দাবি আদায় করবে বা বিভিন্ন প্রবলেম সলভ করবে। স্বাভাবিকভাবে তারা মেধা থেকে সরে যাবে। নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশ করার নামে ছাত্রদের ব্যবহার করা হয়।
যুগান্তর:মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ
ব্যারিস্টার পার্থ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
সুত্রঃ যুগান্তর