আমরা এগিয়ে চলেছি! কোন দিকে?

0
60

বাংলাদেশে পা দিলেই একটা বাক্য কর্ণগোচর হয় সেটা হল, ‘আমরা এগিয়ে চলেছি’, ‘দেশ এগিয়ে চলেছে’! কোন দিকে এগিয়ে চলেছে? প্রশ্ন করার মত মুখ নেই।

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও আমাদের অর্থনীতি নেপাল, আফগানিস্তানের পিছনে পড়ে আছে ।শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় শৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই। শহরগুলোর উঁচু-উঁচু রাস্তার আশেপাশেই গৃহহীনদের আস্তানা। আইন শৃঙ্খলা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। বাজার ব্যবস্থা সিন্ডিকেট নামক শয়তানের হাতে বন্দী। গ্যাস পানি বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় নেই নেই হাহাকার। মানুষ রোগে চিকিৎসা পাচ্ছেনা। তারপরও শুনতে হচ্ছে দেশ এগিয়ে চলেছে!

উত্থান, পতন, সংগ্রাম, স্বাধীনতা, একটা জাতিকে বড় হতে সাহায্য করে। আত্ম সচেতন করে তোলে। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার ৫৩টা বছর পার হয়ে গেল, বড় জাতি হওয়া তো দুরের কথা, তারা কোন জাতি সে পরিচয়টাও আজ পর্যন্ত নির্ধারণ হলনা। দেশ আছে কিনা, দেশের স্বাধীনতা আছে কিনা সে ব্যাপারেই মানুষ সন্দিহান হয়ে পড়েছে, এমতাবস্থায় ‘এগিয়ে চলার গল্প’ কর্ণপটাহবিদ্ধকারি এক শলাকা বিশেষ নয় কি!

বাংলার মুসলমানদের শোষণ বঞ্চনার যারা ভারতীয় প্রতিনিধি ছিলেন সেই, রবীন্দ্র, বঙ্কিম, গান্ধী প্যাটেল, সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, গুজরাল, মোদী, আদানী প্রমুখের গুণকীর্তন অষ্টপ্রহর দেশের ভিতরে বাজছে।

শিল্পী নামধারী ভারতীয় নাভি-নৃত্যপটিয়সীদের জন্য বর্ডার খুলে দেয়া আছে। তারা দলে দলে আসছে, নাচছে, তরুণ কিশোরদের নাচাচ্ছে, কোটি কোটি টাকার নজরানা নিয়ে চম্পট দিচ্ছে। অথচ দেশের শিল্পী তাদের শিল্পকর্ম, যেমন চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, চিত্রকর্ম ইত্যাদি মুখথুবড়ে পড়ে আছে, তাঁদের খবর নেয়ার কেউ নেই।

দেশের দোকান বাজার গুলো দেখলে কোলকাতার বাজারের সাথে পার্থক্য করা যাবেনা। ৫৩ বছর আগে আমরা তো দেশের তৈরি টুথব্রাশ ব্যবহার করতাম, দেশের তৈরি টিউব লাইট জ্বালাতাম, দেশের তৈরি ফ্যানে হাওয়া খেতাম। দেশের তৈরি মাখন দিয়ে নাস্তা করতাম। সেগুলো সব উবে গেছে। দেশের শিল্প-কারখানা যা ছিল সবই প্রায় নির্মূল হয়ে গেছে। এখন যেটাতেই হাত দেবেন, সবটাই ভারতীয়!

দেশটার যা কিছু অর্জন ছিল, ৫৩ বছর ধরে সবই প্রায় ভারতের পায়ে অঞ্জলি দিয়েছে। লাভের পাট-ব্যবসা ভারতকে ছেড়ে দিয়েছে। পানির হিস্যা ভারতকে ছেড়ে দিয়েছে। দেশের ভিতরদিয়ে ওদের ইচ্ছেমত যাতায়াতের রাস্তাঘাট ছেড়ে দিয়েছে। নদীবন্দর ব্যবহারের অধিকার দিয়েছে। ব্যনিজ্যের একচেটিয়া অধিকার দিয়েছে। দেশে গ্যাস বিদ্যুৎ সাপ্লাইয়ের দায়িত্ব দিয়েছে। আমাদের সমুদ্র তদারকির ভার ভারতের হাতে তুলে দিয়ে দিয়েছে। খবরে দেখলাম বাংলাদেশ তার নিজস্ব সমুদ্র এলাকায় সম্পদ খোঁজ করার চেষ্টা করলে, ভারত বাধা দিচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছেন ভারতকে যা দিয়েছি ভারত তা চিরকাল মনে রাখবে। দেশটা কি প্রধানমন্ত্রীর পৈত্রিক সম্পত্তি, যে তিনি নিজ ইচ্ছায় দেশের যা কিছু দিয়ে দিতে পারেন যা দেশের মানুষের জানারও অধিকার নেই? তাহলে তো শঙ্কা হবেই, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব শব্দটা টিকে আছেতো, না সেটাও ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে?

দেশের যখন এ হেন পরিস্থিতি, তখন দেশের বুদ্ধিজীবী, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া তারস্বরে চিৎকার করছে— আমাদের মুসলমানিত্বসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা জয় করে বাঙালিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

তাদের এই বাঙালিত্ব প্রতিষ্ঠার অর্থ জানতে বেশি লেখাপড়ার প্রয়োজন হয়না, সামান্য বুদ্ধি থাকলেই চলে।

কেউ মুখ খুলে বলছেনা, ওরে মূর্খের দল – মুসলমানিত্বসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা তোর বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটা নিজেই। মুসলমানিত্ব নামের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হলে তো বর্ডার তুলে দিয়ে দেশটাকে একাকার করে দিতে হবে। যার ফলে তোদের মত বোকাদের সাজানো খেলাঘরই তো ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবে।

মুসলমানিত্বের বর্ডার আছে বলেই চুপ্পু গুপ্পু প্রেডিডেন্ট হয়েছে, আমিনা জরিনা প্রধানমন্ত্রী হয়েছে, কাগা বগা মন্ত্রী হয়েছ, চা-ছপ মার্কা ভাইসচ্যান্সালার হয়েছ, একই পদের ব্যংকার, ব্যবসায়ী বনে গেছে। বর্ডার না থাকলে তো এসব শিক্ষা, যোগ্যতা নিয়ে জুতাপালিশ করতে হতো। নয়ত হাওড়া ময়দানে কাটাকাপড় ব্যবসা করা, ছাড়া ভাগ্যে অন্যকিছু জুটতো কি? আজকের গাড়িহাঁকানো, ছড়িঘোরানো সবই তো এই বর্ডারের কৃপায়। এই সামান্যবুদ্ধিটুকু খুইয়ে বসে আছো?

বাংলাদেশের বোকাবাস্ক টেলিভিশনগুলো তাদের মগজধোলাই মেশিনে, দিনে রাতে একই গান বাজাচ্ছে, সেটা হল- ওরা বাঙালী আমরা বাঙালী। ওদের ভাষা বাংলা আমাদের ভাষা বাংলা। ওদের সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতি ও এক। সুতরাং বর্ডারের চেকপোস্ট ছাড়া আমাদের কোন বিভেদ নেই। বাঙ্গালী সুক্তো খেতে, পূজোউপাচার সাজাতে, সিঁদুর পরতে, শাঁখবাজাতে, সন্ধ্যাপ্রদীপ, মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালাতে ভুলে যাচ্ছে বলে গানে কবিতায় সে কি আকুলতা! ওরা মানুষকে বুঝায়, ভাষা এক হলে নাকি জাতিসত্ত্বা আলাদা থাকতে পারেনা।

ওরা চোখে দেখেনা যে ইংল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড, একই ইংরেজি ভাষার দেশ হয়ে আলাদা দেশ আছে কি করে! সৌদি আরব, মিশর, কুয়েত, কাতার আরবি ভাষাভাষীর দেশ হলেও মিলেমিশে একহয়ে যাচ্ছেনা কেন! বিশাল কানাডা দুই ভাষা নিয়ে একদেশ, একজাতি হয়ে বাস করছে কী করে! কারন তারা বুদ্ধিমান জাতি, তারা জানে যে শক্তিশালী বড় দেশকে টুকরা করে ছোট করলে দেশ দূর্বল হয়ে পড়ে, তখন উন্নয়ন দূরে থাক, স্বাধীনতা রক্ষা করাই তার জন্য দূরুহ হয়ে পড়ে!

মানুষের বুদ্ধির গোড়ায় ধূয়া দিয়ে অন্ধকার করার জন্য ভারতের খরিদা এদেশীয় দাসরা ভারতের শেখান আরেকটি বানী খুব জোরেশোরে উচ্চারণ করেন। সেটা হল- ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়েছিল বলেই নাকি পাকিস্তান টেকেনি।

তাহলে ভারত টিকেআছে কি করে? উত্তরভারতের ব্রাম্ভনদের সাথে, পশ্চিম ভারতের মারাঠারা টিকে আছে কি কর? ভারতের দ্রাবিড়দের সাথে বাঙ্গালার মছলীখোর বাঙালীরা একই রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে বাস করছে কি করে। তাদের মধ্যে হিন্দু ধর্মীয় বন্ধন ছাড়া, খাবার দাবার, আচার ব্যবহার, পোষাক সংস্কৃতির কিছুরই তো মিল নেই। একমাত্র হিন্দু ধর্মিয় বন্ধনই তো ভারতকে অখন্ড-ভারত করে রেখেছে।

সেখানে কেউ তাদের বর্ণবাদীও বলেনা সাম্প্রদায়িকও বলেনা। বরং তারা একহয়ে উগ্র হিন্দুত্ত্ববাদী দল বাজপা এর হাতে ভারতের শাসনভার তুলে দিয়েছে। গুজরাটের কসাই নামে পরিচিত মোদী কে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছে। ভারতে বসবাসকারী ১৮ কোটি মুসলমান, কসাইয়ের খামারে বাঁধা গরু ছাগলের মত ভারতে বাস করছে , কখন কার গর্দান যাবে কেউ জানেনা। তারপরও কেউ বলেনা ভারত কট্টর ব্রাহ্মন্যবাদী সাম্প্রদায়িক দেশ! অথচ বাংলাদেশ ৯৮% মুসলমানের দেশ হওয়া সত্ত্বেও এখানে জামাতে ইসলামী নামের দল নিষিদ্ধ হয়!

এই ভারত প্রেমী বাঙ্গালীরা একবারও ভেবে দেখছেনা যে, ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা হয়েছিল বলেই Rural slum নামের ব্রিটিশদের অবহেলিত পূর্ববাংলার ৫৫হাজার বর্গ মাইলের নাঙ্গা ভুখা হাড়-জিরজিরে সেদিনের ৪ কোটি মুসলমানের মৃতদেহে প্রাণ ফিরে এসেছিল। লাঙ্গলের পেছনের মানুষ আখ্যায়িত মানুষগুলো রাষ্ট্রক্ষমতায় বসতে পেরেছিল। ২০০শ বছর পর জেলা শহর ঢাকা, রাজধানীর মর্যাদা পেয়ে ঝলমল করে উঠেছিল। দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত শিল্পকারখানায় ভরে উঠেছিল। ঢাকা কে কেন্দ্র করে শিল্প সাহিত্য অঙ্গনে অচ্ছুৎ মুসলমান ছেলেমেয়েদের দৃপ্ত পদচারনা শুরু হয়েছিল। Physically Unfit নামের কলঙ্ক ঘুচিয়ে বাংলাভাষী ছেয়েমেয়েরা দেশের স্থল, বিমান, নৌবাহিনীতে প্রবেশাধিকার পেয়েছিল। কোটা সিস্টেমের সুযোগ পেয়ে বাংলাভাষী মুসলমানের ছেলেরা সচিব, উপসচিব, পুলিশ সার্ভিস, ফরেন সার্ভিসে ঢোকার সুযোগ পেয়েছিল। নৌকরের জাত নামে চির ভাগ্যবিড়ম্বিত পূর্ব বাংলার মানুষ একাধিক জুটমিলের মালিক হতে পেরেছিল। এসবই ছিল ১৯৪৭এর দান।

সেই দানকে আজ অস্বীকার করা হচ্ছে কেন? ১৯৪৭ সালে যারা পাকিস্তানে যোগ দেবার জন্য আইন সভায় ভোট দিয়ে পাকিস্তান ছিনিয়ে এনেছিল, পরবশ্যরা পরোক্ষভাবে সেই সংগ্রামী পূর্বপুরুষদের দেশদ্রোহী প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হচ্ছে কেন জানতে হবে।

নিজেরা তুর্কি বা ফারসী ভাষী হয়েও আমাদের পূর্বপুরুষ, যারা পতিত বাংলাভাষাকে জাতে তুলেছিলেন। যারা জীবন বাজী রেখে এদেশের মানুষকে বর্গী-মারাঠা দস্যুদের খুন লুণ্ঠন থেকে বাঁচাতে সংগ্রাম করেছিলেন। যারা নিজেদের জমিদারি বন্ধক রেখে এদেশের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে দিয়েছিলেন—তারা হয়ে গেলেন বহিরাগত, উৎপীড়ক। আর যে শিবাজী ভাস্করপন্ডিতের দল এদেশকে লুণ্ঠন করলো, এদেশের হাড় জিরজিরে মানুষের উৎপাদিত কাঁচামালের পয়সায় কলকাতার সমৃদ্ধি ঘটালো, যে রবিঠাকুর এদেশের গরীব চাষীদের দমন পীড়নের পয়সায় বোলপুরে শান্তিনিকেতন গড়লেন। যে বাঙালী বাবুরা ইংরেজদের সহায়তায় রাতারাতি বড়লোক হয়ে এদেশের মুসলমানদের বাড়ীর ভিতরে ঢুকতে দিতনা , এক আসনে বসতে দিতনা , তারা হয়ে গেলেন পরমপূজ্য আপন জন। আজকের প্যান্ট শার্ট পরা মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা তাদেরই নান্দীপাঠ করছেন। কেন?

এর রহস্য অনুধাবন করতে হবে। বুঝতে হবে, এভাবেই শিক্ষায় সংস্কৃতিতে, মিডিয়া প্রচারে, চালচলনে, বিগত ৫৩ বছর ধরে ওরা আমার আমিত্বকে ভুলিয়ে দিয়েছে। মনের দিক থেকে আমরা দাস হয়ে পড়েছি।

আমরা মুসলমানিত্ব ছেড়ে বাঙ্গালী হয়েছি। আমরা এক আল্লার উপর আস্থা ছেড়ে ওদের মত অগ্নিপূজক শিখাঅনির্বানের উপর আস্থা রাখছি। আমরা ছেলেমেয়েদের নাম রাখছি ওদের মত। ভাষা বলছি ওদের মত। পোষাক নকল করছি ওদের মত। অনুষ্ঠান পালা পার্বণ পালন করছি ওদের মত। সংস্কৃতি পালন করছি ওদের মত। রাজনীতি করছি ওদের মত। দেশ চালাচ্ছি ওদের নির্দেশ মত।

এভাবে বাংলাদেশের মানুষের চৈতন্য, বুদ্ধি, আবেগ, চিন্তাশক্তিকে ভোঁতা করে রোবটের মত ভারতীয় আজ্ঞাদাসে পরিনত করা হয়েছে। ওরা যা বলছে বাংলাদেশ মানুষ তাই করছে। ওদের নিয়োজিত নেতারা গলা ফাটিয়ে বলছে এভাবেই- আমরা এগিয়ে চলেছি! কেউ প্রশ্ন করছেনা, কিন্তু কোন দিকে? তিনদিক-ই বন্ধ! একমাত্র দখিনা দুয়ার খোলা! তবে কি ভারত সাগরে!

লেখক: আরিফুল হক,  বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বহু গ্রন্থের লেখক

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here