গেল ৭ই জানুয়ারি বিএনপিসহ বেশ কিছু দলের দীর্ঘদিনের দাবি ‘নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন’ উপেক্ষা করে সংবিধান রক্ষার মোড়কে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো তার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের আগামীর সংসদ হবে বিরোধী দলবিহীন বাকশাল মডেলের সংসদ, সংসদীয় গণতন্ত্রের সংসদ নয়।
সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদ কখনও বিরোধী দলবিহীন হয় না। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে যে বাকশাল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা ছিল সকল দলকে একদলে রূপান্তরিত করত: সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বদলে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার প্রবর্তন। আর এবারকার বিষয়টি হলো, সংসদীয় ব্যবস্থায় বাকশাল বা একদলীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা, যেখানে বিরোধী দলের কোনো অস্তিত্ব নেই যা মূলত: সংসদীয় গণতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য বিরোধী। এটি কিভাবে হতে পারে, যদিও বিষয়টি সবার কাছে বোধগম্য, তারপরেও কিছুটা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে। এই মৌলিক বিষয়টি আলোচনার পূর্বে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দলের গুরুত্ব ও ভূমিকা এবং কারা বিরোধী দল হওয়ার যোগ্য এ বিষয়ের উপর কিছুটা আলোকপাত করব।
সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত কোন রাষ্ট্রের সংসদ বা আইন পরিষদ গঠনে ন্যূনতম দুটি দলের উপস্থিতি অপরিহার্য। মূলত: এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় বহু দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। নির্বাচনে বিজয়ী মেজোরিটি বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে, আর মাইনোরটি দল সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে থাকে। জোটভিত্তিক নির্বাচন হলে বা নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরে কোন জোটে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতার অংশীদারও হতে পারে অথবা বিরোধী দলের অবস্থানও গ্রহণ করতে পারে। সংসদীয় ব্যবস্থায় সুনির্দিষ্ট বিরোধী দল সংসদের হৃদপিণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ বিরোধী দল ছাড়া সংসদীয় পদ্ধতি কখনই সফলভাবে কাজ করতে পারে না।
দায়িত্বশীল ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কল্যাণমূলক সংসদীয় ব্যবস্থাও সৃষ্টি হয় না। তাই আধুনিক গণতন্ত্র কখনই সংসদে কোন দলের crude majority সমর্থন করে না। Political pluralism তথা বিরোধী দলসহ বহুদলের সমন্বয়ে একটি সংসদ প্রতিষ্ঠাই এর মূল দাবি ও লক্ষ্য। বিরোধী দলবিহীন সংসদ সরকারকে একনায়কতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারী সরকারে পরিণত করে, দলীয় ও ব্যক্তিস্বার্থে সংসদকে ব্যবহার করার অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করে যেখানে জনগণের মৌলিক চাহিদা ও অধিকারের বিষয়গুলো চরমভাবে অবহেলিত হয়। সংসদে বিরোধী দলের গুরুত্ব প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেনিংস এর মত হলো, if there is no opposition, there is no democracy অর্থাৎ বিরোধী দল ছাড়া সংসদীয় ব্যবস্থা একটি গণতন্ত্র শূন্যহীন ব্যবস্থা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইলবার্ট এর মতে, একটি সতর্ক ও দায়িত্বশীল বিরোধী দলের গঠনমূলক সমালোচনা ছাড়া সংসদ কখনই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে না (যা বিগত দিনে বাংলাদেশে বিরোধী দলের ভূমিকায় প্রমাণিত হয়)। সত্যিকারের বিরোধী দল সংসদে watch-dog এর ভূমিকা পালন করে, সরকারের অগণতান্ত্রিক ও জনস্বার্থবিরোধী পদক্ষেপের সমালোচনা করত: সরকার ব্যবস্থা সঠিক পথে পরিচালিত হওয়ায় সহায়ক শক্তি হিসেবে দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করে, সংসদকে দলীয় সরকারের ক্রীড়ানক হতে বাধার সৃষ্টি করে। এ জন্য বলা হয় গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে সংসদে বিরোধী দল আবশ্যক। অন্যথায়, সংসদ একদলীয় শাসনে পরিণত হয়।
এখন মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক। গেল নির্বাচনের ফলাফলের আলোকে প্রশ্ন জাগে এবারের সংসদে সম্ভাব্য বিরোধী দল কে হবে বা বিরোধী দল ছাড়াই কি সংসদ হবে? প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২২২টি আসন, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত ৬২ জন এবং জাতীয় পার্টি পেয়েছে ১১টি আসন। উল্লেখ্য, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ২(দুই) জন ছাড়া সবাই আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। আওয়ামী লীগ majority দল হিসেবে সরকার গঠন করবে এটাই আইন সম্মত। এরপর সর্বোচ্চ সংখ্যক নির্বাচিত ব্যক্তিরা হলো স্বতন্ত্র প্রার্থী। নির্বাচন বিধি মতে তারা কোন সুনির্দিষ্ট দলের প্রতিনিধিত্ব করে না। সেজন্য সংসদে বিরোধী দল গঠনের যোগ্যতাও তাদের নেই। কেননা minority party বলতে তাদেরকেই বুঝায় যারা রাজনৈতিক আদর্শ ও উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে majority দল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিচয় আছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করলে এটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত নির্বাচন। কোন দলের পক্ষে নির্বাচন নয়। তাই তাদের সমষ্ঠিগত সংখ্যা যতই হোক না কেন রাজনীতি বিজ্ঞানের ভাষা অনুযায়ী সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তারা কখনই minority দল হিসেবে গণ্য হবে না, তাই বিরোধী দলের ভূমিকা পালনও অযোগ্য হিসেবে স্বীকৃত হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা যায় যে, এবারের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে যারা নির্বাচিত তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই আগামী ৫(পাঁচ) বছর দায়িত্ব পালন করবে। অন্য কোন দলে যোগদান করত: দায়িত্ব পালনের অবকাশ তাদের নেই। কেননা এ অধিকার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই ইতোমধ্যেই সীমিত হয়ে গেছে। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়লাভের পর নতুন দল গঠন করত: বিরোধী দল হওয়ার সুযোগও নেই। বাস্তবতা হলো, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তারা কখনই সংসদে নিজস্ব অবস্থানে থেকে বিরোধী দলের মত ভূমিকা পালনের অভিনয় করার ক্ষমতাও তাদের নেই। কেননা, তারা তাদের দল তথা আওয়ামী লীগের নেত্রীর বদন্যতায় নির্বাচনে অংশগ্রহণে সক্ষম হয়েছে।
এখন ধরা যাক জাতীয় পার্টির কথা। তাদের নির্বাচিত সদস্যের সংখ্যা সর্বমোট ১১, এ সংখ্যা দিয়ে বিরোধী দল গঠন বাংলাদেশের সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রচলিত নিয়মের বাইরে। প্রচলিত নিয়ম অনুসারে বিরোধী দল হিসেবে অফিসিয়ালি স্বীকৃতি পেতে হলে অত্র দলের আসন সংখ্যা ন্যূনতম ২৫ হতে হবে, যা বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে নির্ধারিত হয়। পূর্ববর্তী নির্বাচনের ফলাফলে জাতীয় পার্টির সে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাচিত সদস্য ছিল তাই তারা সংসদে বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল। যদিও তাদের ভূমিকা ছিল নামে মাত্র। সমালোচকের দৃষ্টিতে, গণতান্ত্রিক ইতিহাসে তারাই একমাত্র বিরোধী দল যারা ভূমিষ্ঠ হয়েছে সরকারী দল আওয়ামী লীগের উদর হতে। এতসব বিবেচনায় বাংলাদেশের এবারকার সংসদ হতে চলেছে বিরোধী দলবিহীন। অতএব এ আশঙ্কা করলে ভুল হবে না যে, আগামীর সংসদ একদলীয় সংসদ হতে যাচ্ছে, এর মাধ্যমেই পুরনো বাকশালী ব্যবস্থা সংবিধানের আবরণে আবারও প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সংসদীয় গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটার সম্ভাবনাই বেশি।
লেখক –
ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ
অধ্যাপক, আইন বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।