রাজনীতিতে নানা ধরনের বিস্ময় থাকে। আমাদের রাজনীতি পুরোটাই বিস্ময়-জাগানিয়া। রাজনীতিবিদেরা বলেন একটা, কিন্তু বাস্তবতা দেখা যায় ভিন্ন। কখন কী হবে, বলা মুশকিল। এই যেমন নানা জল্পনাকল্পনা, সমীকরণ, হাজারো বিচার-বিশ্লেষণকে পাত্তা না দিয়ে আওয়ামী লীগ ৭ জানুয়ারি নির্বাচন করে ফেলল।
নির্বাচনের আগে নানা ঘটনার কারণে অনেকেই মনে করেছিলেন, এবার মনে হয় আওয়ামী লীগ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করতে পারবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তেমনটা হয়নি। কোনো ঝামেলা ছাড়াই নির্বাচন হয়ে গেছে। এবারের নির্বাচনের নতুনত্ব হচ্ছে, সবদিকেই আওয়ামী লীগ। স্পিকারের ডানেও থাকবে আওয়ামী লীগ, বাঁয়েও থাকবে আওয়ামী লীগ; মানে সরকারি দলেও আওয়ামী লীগ, বিরোধী দলেও আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের বাইরে সর্বোচ্চ আসনেও জিতেছে আওয়ামী লীগই। স্বতন্ত্রদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগেরই লোক। এই রকম সংসদ আমরা আগে দেখিনি। এই সংসদ আরও কী কী বিস্ময় উপহার দেয়, তার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে
নির্বাচনের ফলাফলের মতো ভোটের হারও বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। সারা দিন ভোটকেন্দ্রগুলো ছিল ফাঁকা। সারা দেশে কমবেশি একই চিত্র ছিল। কিন্তু প্রথমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বললেন, ২৮ শতাংশ ভোট জমা হয়েছে। এরপর ঘুম থেকে উঠে স্বপ্নে পাওয়া আদেশের মতো তিনি ভোট নিয়ে গেলেন ৪০ শতাংশে।
ভোটের দিনের চালচিত্র বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার বোঝা যায়, ভোট প্রদানের হার খুবই কম ছিল। ভোট দেওয়ার যে সব হার নানা মহল থেকে শোনা গেছে তাতে এটা পরিষ্কার যে আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থকেরাও ভোট দেননি।
আওয়ামী লীগের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ভোট থাকার কথা। ভোটের দিনের ফাঁকা ভোটকেন্দ্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের সমর্থকেরাও ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে ঘরেই বসে ছিলেন।
তবে এসব নানা বিস্ময়কে ছাপিয়ে রাজনীতিতে সব থেকে বড় বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে বিএনপি। এই যে আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা ভোট দিলেন না, বিএনপির নেতারা নানা চাপ ও প্রলোভনেও দল ছেড়ে নির্বাচনে গেলেন না—তার সুবিধা বিএনপি নিতে পারল না।
রাজনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেও বিএনপি মাঠ থেকে লাপাত্তা হয়ে গেছে। সৌভাগ্য মানুষ কীভাবে পায়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়, তা বিএনপিকে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। তাই ঘরোয়া কর্মসূচিতেই বিএনপির কার্যক্রম এখন সীমাবদ্ধ। গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে বলা যায়, বিএনপি সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল।
প্রথমত আওয়ামী লীগের ওপর একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক চাপ ছিল। অধিকাংশ জনগণ ও দল বিএনপির সঙ্গে ছিল। অর্থনৈতিক কারণে জনমতও আওয়ামী লীগের পক্ষে খুব বেশি নয়। এসব সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বিএনপি শেষ পর্যন্ত সুফল ঘরে তুলতে পারেনি। শিগগিরই পারবে বলেও ভাবগতি দেখে মনে হচ্ছে না।
৭ জানুয়ারি বিকেল পর্যন্ত বিএনপি এগিয়েই ছিল আওয়ামী লীগের তুলনায়। শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়েছিল। জনসাধারণ বিএনপির এই ডাকেই সাড়া দিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাননি।
বিএনপি রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তনের সূচনা করেছে। গত ২৮ অক্টোবরের পর শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করেছে। যেনতেন প্রকারে সহিংস আন্দোলন করে ক্ষমতার পালাবদলের পথে হাঁটেনি নানা উসকানি সত্ত্বেও। অনেকেই উপযাচক হয়ে বিএনপিকে পরামর্শ দিয়েছে রাজপথ কাঁপাতে। কিন্তু বিএনপি শান্তিপূর্ণ অবরোধ, অসহযোগ করেছে। শেষে নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা না দিয়ে বর্জনের ডাক দিয়েছে।
আওয়ামী লীগসহ অনেকেই ধারণা করেছিল, বিএনপি নির্বাচন প্রতিহতের ডাক দিতে পারে। কিন্তু বিএনপি সহিংস পথে না যাওয়ায় জনমনেও ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল। আরেকটি জায়গায় বিএনপি সফল ছিল। পাহাড়সমান চাপকে মোকাবিলা করে বিএনপিতে ভাঙন ধরাতে পারেনি আওয়ামী লীগ। একমাত্র শাহজাহান ওমর ছাড়া আর কাউকে দলছুট করতে পারেনি।
কিন্তু প্রবল জনসমর্থন, অনুকূল পরিস্থিতি থাকার পরও ৭ জানুয়ারি বিকেল থেকে বিএনপি আস্তে আস্তে পিছু হটতে থাকে। ভোটের দিন দেশের মানুষ আশা করেছিলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা আসবে।
সারা দেশের মানুষ বিএনপির ডাকে ভোট দেননি। বলা যায় ভোট বর্জন করেছিলেন। এর বিপরীতে বিএনপির পক্ষ থেকে দ্রুত প্রতিক্রিয়া আশা করেছিলেন। বিএনপির শীর্ষ নেতার ওই দিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভাষণ দেওয়া উচিত ছিল। তাহলে বিএনপি রাজনীতির মোক্ষম মুহূর্তটা ধরতে পারত।
বিএনপি রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের ইচ্ছার বাইরে এক পা-ও আগাতে পারছে না। এই যে বিএনপি সভা, সমাবেশ, মিছিল করে, এটাও আওয়ামী লীগ করতে দেয় বলেই পারছে। যেদিন বিএনপি নিজের মেধা, শক্তি ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের ইচ্ছার বাইরে এক পা হলেও আগাতে পারবে, সেদিনই বিএনপি সফল হবে, এর আগে নয়।
যত দূর জানা যায়, বিএনপির ভেতরে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনাও হয়েছিল। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে নির্বাচনের দিন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ভাষণ দেননি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দিনভর নীরবতা দিয়েই বিএনপির পিছু হটা শুরু।
ভোটের এক দিন পর তিনি ধন্যবাদ জানিয়ে একটি সাদামাটা ভাষণ দেন, যা জনমনে দাগ কাটতে পারেনি মোটেও। উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারেনি। ওই ভাষণ আলোচনায় ছিল না মোটেও। মানে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়িয়ে টক অব দ্য কান্ট্রি হতে পারেনি ভাষণটি। অথচ গণহারে ভোট বর্জনের পর তিনি ভাষণ দিয়ে সারা দেশ আলোড়িত করতে পারতেন।
মূলত বিএনপির নির্লিপ্ততা দেখেই আওয়ামী লীগ গুছিয়ে নিতে শুরু করে এবং নির্বাচনের পরপর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বড় একটি সমাবেশ করে। অথচ ভোটের পর ঢাকা শহরে সব থেকে বড় সমাবেশটি করার কথা ছিল বিএনপির।
আওয়ামী লীগ এই কাজ ত্বরিত সিদ্ধান্তে করেছে। রাজনীতিতে ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা যেকোনো দলকে অনেকটাই এগিয়ে রাখে। কিন্তু বিএনপি বারবারই ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। যে কারণে বারবার আন্দোলন গুছিয়ে এনেও শেষ মুহূর্তে ফল ঘরে তুলতে পারছে না।
মোটাদাগে বিএনপি কৌশলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেনি। যেমন বিএনপির পররাষ্ট্র কৌশল পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
যাঁরা বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন ও কথা বলেছেন, হয় তাঁরা তথ্য গোপন রেখেছেন দলের কাছে, অথবা নিজেরাই বিদেশিদের বার্তা বুঝতে পারেননি। বিএনপির রাজনীতির অন্যতম ভুল হচ্ছে, ভারতের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করা।
আওয়ামী লীগ থাকতে ভারত অন্য কোনো দলের সঙ্গে সমঝোতা করবে না। ভারতের আমলা ও সুশীল সমাজ আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রাখার পক্ষে। তাই ভারতের সঙ্গে বিএনপিকে কূটনীতিতে দক্ষ হতে হবে। দর-কষাকষি করে নিজের স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সম্প্রতি বিএনপি ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে গিয়ে ক্রীড়াতত্ত্বের সেই মুরগিতে পরিণত হয়েছে, যে আগেই পথ ছেড়ে দেয় ভয়ে।
এ জায়গায় বিএনপিকে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। কূটনীতি, রাজনীতি ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতি নিয়ে সম্যক ধারণা রাখেন, এমন লোকেদের নিয়ে সবকিছু ঢেলে সাজাতে হবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিব সরাসরি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে পারেন। কারণ, যাঁরা বিএনপির হয়ে এসব বিষয়ে যোগাযোগ করেন, তাঁরা ফলপ্রসূ আলোচনা করতে পারেননি বলেই বিএনপি সফল হতে পারছে না।
সব মিলিয়ে বিএনপি বরং ঘুরেফিরে একই পথে হাঁটছে। বিএনপি নাকি আবারও বিভাগীয় পর্যায়ে মহাসমাবেশের চিন্তাভাবনা করছে। বিভাগীয় মহাসমাবেশের পরিণতি কী হয়েছে, আমরা আগেও দেখেছি। সারা দেশে মহাসমাবেশ করে বিএনপি শেষ পর্যন্ত ঢাকায় নিয়ন্ত্রিত সমাবেশ করেছে গোলাপবাগে।
পল্টন ছেড়ে গোলাপবাগে সমাবেশ করা ছিল বিএনপির জন্য পরাজয়ের শামিল। এখন আবারও বিভাগীয় সমাবেশ করার কথা ভাবছে। সমাবেশে আসার পথে আগের মতোই হাজারো নেতা-কর্মী হামলা-মামলার শিকার হবেন। এমনিতেই ২৮ অক্টোবর সমাবেশের পর বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু হয়।
মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতাদের আটক করা হয়। বিএনপির হিসাবে ২০ হাজার নেতা-কর্মী কারাগারে। ঘরছাড়া হয়েছেন প্রায় কোটির ওপরে। এখনো বিএনপির হাজারো নেতা-কর্মী ফেরারি জীবনে আছেন। অনেকেই সাজা মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ অবস্থায় বিভাগীয় সমাবেশ করা কঠিন হবে।
বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে বিএনপির রাজনৈতিক বোঝাবুঝিতে ভয়াবহ ধরনের সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি আছে। গত ১৭ বছরের রাজনীতিতে এটা প্রমাণিত হয়েছে একাধিকবার।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখলাম, বিএনপির ভাবনা হচ্ছে, আগে আটক নেতা-কর্মীদের মুক্ত করে আন্দোলনে নামা। বিএনপি কি এখনো মনে করে, দেশের আইন-আদালত নিয়ম মেনে নেতা-কর্মীদের মুক্তি দেবেন। নাকি আন্দোলন না করার মুচলেকা দিয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ছাড়িয়ে আনবে। মুচলেকা দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প তো নজরে পড়ছে না।
মূল বিষয়, বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে এসব বিষয়ে মোকাবিলা করতে হবে। রাজনীতি মানেই সহিংসতা ও ভাঙচুর নয়, আরও অনেকভাবে রাজনীতি করা যায়। বিএনপি এই জায়গায়ই বারবার মার খেয়ে যাচ্ছে। বিএনপিকে বারবারই রাজনীতি থেকে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। আর এই কাজ হামলা-মামলা, দমন-পীড়ন ছাড়াও বিএনপির ভেতরে অবস্থান করা একটি অংশকে দিয়ে করিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
সম্ভবত বিএনপির ক্ষমতাকাঠামোর কাছাকাছি ঘাপটি মেরে থাকা একটি ক্ষুদ্র অংশই চাইছে না, বিএনপি সফল হোক। এরাই নানা পরামর্শ দিয়ে বিএনপিকে ভুল পথে পরিচালিত করছে। বিএনপির নির্লিপ্ততা, বারবার একই পথে হাঁটা এই অংশেরই কলকাঠি নাড়ার ফলাফল। আওয়ামী লীগ চায় না বিএনপি সফল হোক। আবার পুরোপুরি বিলুপ্ত হোক, এটাও চায় না।
দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকা কিছুটা ভীত, সিদ্ধান্তহীন বিএনপিই আওয়ামী লীগের জন্য সুবিধাজনক হবে। কারণ, দুর্বল বিএনপি টিকে থাকলে নতুন কোনো শক্তির উত্থান হবে না। আওয়ামী লীগ ২০১৪, ২০১৮ বা এবারের মতো নির্বাচন করে পার পেয়ে যাবে দুর্বল বিএনপিকে মাঠে রেখে। অংশটি মূলত বিএনপির ভেতরে অবস্থান করে আওয়ামী লীগের স্বার্থই রক্ষা করতে পারে।
এটা তারা পরিকল্পিতভাবে করতে পারে। আবার একদমই রাজনীতি না বুঝে বোকার মতো করতে পারে। এদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে না পারলে শিগগিরই বিএনপির সফল হওয়ার সুযোগ কম।
মোদ্দাকথা হচ্ছে, বিএনপি রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের ইচ্ছার বাইরে এক পা-ও আগাতে পারছে না। এই যে বিএনপি সভা, সমাবেশ, মিছিল করে, এটাও আওয়ামী লীগ করতে দেয় বলেই পারছে। যেদিন বিএনপি নিজের মেধা, শক্তি ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের ইচ্ছার বাইরে এক পা হলেও আগাতে পারবে, সেদিনই বিএনপি সফল হবে, এর আগে নয়।
ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক