অসাম্প্রদায়িকতা ও রবীন্দ্রনাথ

0
12

আরিফুল হক

গত ৭ মে ১৯২৪ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩ তম জন্মদিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা।” সত্যিই কি তাই?

রবীন্দ্রনাথ নিজেকে ঋষির মত সাজিয়ে রাখলেও তিনি ঋষি ছিলেন না। তিনি ছিলেন দোষে গুনে মানুষ। তিনি ছিলেন ভোগলিপ্সু জমিদার, অহংকারী, শোষক, রাজ-অনুগ্রহ লোভী, ব্রাহ্ম হয়েও হিন্দুত্ববাদী ভাবধারার অনুরাগী।

তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা সম্পন্ন ছিলেন একথা রবীন্দ্র জীবন, কর্ম, ধর্ম, বিশ্বাস, সাহিত্য অর্থাৎ সৃষ্টি, কৃষ্টি কোন কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাবেনা। বিশ্লেষন করলে বরং বিপরীত চিত্রটি প্রকট হয়ে ধরা দেবে!

রবীন্দ্রনাথের জমিদারির সম্পূর্ণ অংশই ছিল পূর্ববাংলায়। রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া প্রভৃতি অঞ্চল জুড়ে ছিল রবীন্দ্রনাথের পৈত্রিক জমিদারি। এই অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষের শ্রম এবং খাজনা ই ছিল রবীন্দ্রনাথের আয়ের একমাত্র উৎস।

কিন্ত তিনি পূর্ববাংলায় বসবাসকারী মানুষের জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য কোন রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট, চিকিৎসালয় এমন কি একটা প্রাইমারি স্কুলও গড়ে তোলেন নি। অথচ এই পূর্ববাংলার মানুষের শ্রমের পয়সায় তিনি কলকাতা থেকে ২১২ কিঃমিঃ দূরে বীরভূম জেলার বোলপুরে শান্তিনিকেতন গড়েছিলেন। যেখান মুসলমান শিক্ষার্থী দূরে থাক, নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রবেশাধিকার ও প্রাথমিক পর্যায়ে নিষিদ্ধ ছিল।

রবীন্দ্রনাথ যে বঙ্গে জন্মেছিলেন, সেখানকার সংখ্যাগুরু মানুষ ছিল মুসলমান, যাঁদের ধর্ম কৃষ্টি জীবনাচার ছিল ভিন্ন হলেও, ভাষা ছিল বাংলা। তারাও বিশ্বকবির পাঠক ছিলেন। অথচ বিশ্বকবির সাহিত্য ভাণ্ডার তন্যতন্য করে খুঁজলেও কচ্ছপের ডিমওয়ালা বা পাহারাদার মুসলমান ছাড়া কোন উন্নত মুসলমানের চরিত্র তাঁর সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া যাবেনা।

লেখা বড় করবোনা। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বা লেখা থেকে কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরলেই তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনার লেবাসটা পাঠক অনুধাবন করতে পারবেন!

১৮৮১ সালে মাত্র ২১বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের লেখা রুদ্রচন্ড নাটকে তিনি মুসলমান নিয়ে লিখেছেন-

“ম্লেচ্ছ সেনাপতি এক মোহাম্মদ ঘোরী/ তস্করের মত আসে আক্রমিতে দেশ!”..

প্রায়শ্চিত্ত নাটকে প্রতাবাদ্যিত্যের মুখে রবীন্দ্রনাথ বলছেন—

“খুন করাটা যেখানে ধর্ম যেখানে না করাটা পাপ। যে মুসলমান আমাদের ধর্ম নষ্ট করেছে তাদের যারা মিত্র তাদের বিনাশ নাকরা অধর্ম।”

হিন্দুত্ববাদের প্রতিষ্ঠাতা বাল গঙ্গাধর তিলক ১৮৯৫ সালের ১৫ এপ্রিল মহারাষ্ট্রে যখন হিন্দু জাতীয়বাদের প্রতীক হিসাবে মারাঠা দস্যু শিবাজী উৎসব প্রবর্তন করলেন, তখন রবীন্দ্রনাথ বর্গীদস্যু শিবাজীকে রাজা সম্বোধন করে ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতা লিখলেন।

বাংলার ত্রাস বর্গীদস্যু শিবাজী রবীন্দ্রনাথের চোখে ধরা পড়ল ‘রাজাধিরাজ ধর্মরাজ’ রূপে। তিনি লিখলেন—

“মারাঠার প্রান্ত হতে একদিন তুমি ধর্মরাজ/ ডেকেছিলে যবে/ রাজা বলে জানি নাই, মানি নাই পাই নাই লাজ/ সে ভৈরব রবে।…

সেদিন শুনিনি কথা/ আজ মোরা তোমার আদেশ/ শির পাতি লব/ …..

ধ্বজা করি উড়াইব বৈরাগীর উত্তরীবসন-/ দরিদ্রের বল/ ‘এক ধর্মরাজ্য হবে এ ভারতে’ এ মহাবচন/ করিব সম্বল।” এই এক ‘ধর্মরাজ্য’ নিশ্চয় ইসলাম, বৌদ্ধ,বা খৃষ্টান ধর্ম রাজ্য নয়!

(এটা কোন বিশ্ব কবির লেখা মনে হয়? মনে হয় যেন যোগী আদিত্যনাথ বা নরেন্দ্র মোদির নির্বাচন নিয়ে লেখা কবিতার লাইন!)

রবীন্দ্রনাথ তার রাজা প্রজা প্রবন্ধ পুস্তকের ‘কণ্ঠরোধ’ প্রবন্ধে লিখেছেন:-

“কিছুদিন হইল একদল ইতর শ্রেণীর অবিবেচক মুসলমান কলিকাতার রাজপথে লোষ্ট্রখণ্ডহস্তে উপদ্রবের চেষ্টা করিয়াছিল। তাহার মধ্যে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, উপদ্রবের লক্ষটা বিশেষরূপে ইংরাজেরই প্রতি।”

এখানে তিনি মুসলমানদের প্রতি ‘ইতর’, ‘অবিবেচক’ শব্দ ব্যবহার করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন রোধ করার জন্য হিন্দু বাবু চক্রান্তের পুরোভাগে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ!

এবিষয়ে শ্রী সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস, মহাশয়ের লেখার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হল,

“১৯১২ সালের মার্চ মাসে কোলকাতার গড়ের মাঠে এক বিশাল মিটিং হয়। যারা কোনদিন কোন মিছিল, সমাবেশে যায় না তারাও গিয়ে মাঠ ভর্তি করে ফেলে। আমাদের মত এত ছোট মিটিং না, বিশাল ডায়াস, বিশাল মিটিং। সেই মিটিং এর সভাপতি হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিসের জন্য সেই মিটিং জানেন? ইংরেজ গভর্নমেন্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকায় একটা ইউনিভার্সিটি হবে তার বিরুদ্ধে। ওই মিটিংয়ে সভাপতি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সিদ্ধান্ত হল ঢাকায় যেন ইংরেজ গভর্নমেন্ট ইউনিভার্সিটি না করে। কেন বলেন তো? ঢাকায়, পূর্ব বাংলায় তো সব মুসলমানের বাস। মুসলমান লেখাপড়া শিখলে তো ব্রাহ্মণ বর্ণের মর্যাদা থাকেনা, মান থাকেনা, সম্মান থাকে না। মুসলমানের ছেলে ডাক্তার আবার ব্রাহ্মণের ছেলেও ডাক্তার। এটা হলে কি ব্রাহ্মণের জাত-মান থাকে? থাকে না। তাই রবীন্দ্রনাথের মত লোক, বিশ্বকবি, তিনি তার প্রতিবাদ করলেন। আমি উনার কথা বেশি বলছি কারন তিনি আমাদের কাছে শ্রদ্ধেয়, অন্য কারনে শ্রদ্ধেয়। তবে যখন আমরা এই বিষয়গুলো আলোচনা করি তখন সত্যিকারের ভেতরের ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যায়। তারা কত বার বলেছিলো জানেন? এই বাবুরা? ১৮ বার স্মারকলিপি দিয়েছিলো যেন ঢাকাতে ইউনিভার্সিটি না হয়। এই যে মানসিকতা, মুসলমানরা যেন লেখাপড়া না শিখতে পারে, তাদের আমরা নেতা বানাচ্ছি।”

১৮৭৫ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘সরোজিনী বা চিতোর আক্রমণ’ নামের নাটকের জন্য গান রচনা করলেন, যা নাট্যগীতি হিসাবে স্বরবিতান ৫১ খণ্ডে লিপিবদ্ধ আছে সেখানেও সাম্প্রদায়িকতার চিহ্ন দেখুন:-

শোন্‌ রে যবন, শোনরে তোরা, যে জ্বালা হৃদয়ে জ্বালালি সবে, সাক্ষী র’লেন দেবতা তার, এর প্রতিফল ভুগিতে হবে।। স্পর্ধিত যবন, তোরাও দেখ্‌ রে, সতীত্ব-রতন করিতে রক্ষণ, রাজপুত-সতী আজিকে কেমন, সঁপিছে পরান অনলশিখে।।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সহকারী অমিয় চক্রবর্তীকে ১৯৩৪ সালে লেখা এক চিঠিতে কবি লিখেছেন:-

“যে মুসলমানকে আজ ওরা প্রশ্রয় দিচ্ছে সেই মুসলমানেরাই একদিন মুষল ধরবে।”

যারা রবীন্দ্রনাথের হিন্দু মুসলমান চেতনা সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহী তারা কবির কালান্তর গ্রন্থটি পড়ে দেখতে পারেন। সেখানে তিনি বলছেন:-

“কোন বিশেষ প্রয়োজন না থাকলেও হিন্দু নিজেই মারে, আর প্রয়োজন থাকলেও হিন্দু অন্যকে মারতে পারে না। আর মুসলমানেরা বিশেষ প্রয়োজন না ঘটলেও নিজেকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে, আর প্রয়োজন হলে অন্যকে বেদম মার দিতে পারে।”

এরকম ইতিহাস আরও শত শত দেয়া দেয়া যেতে পারে! তাতে লাভ কি? বাঙালী মুসলমানের অর্ধেক আছে যাদের মগজ অর্ধেক খালি, আর বাকি অর্ধেক যারা পরদেশির কাছে মগজ বেঁচে দিয়ে দেউলিয়া হয়েছে। এই মগজ বেঁচা দল মনে করে, ওই পরদেশিরাই সব, আমাদের কিছু নেই! ওরা আছে বলে আমরা আছি! দূর্ভাগ্যবশতঃ এই মগজ বেঁচাগুলিই এখন শক্তিমান। এদেরই জয়জয়কার!

লেখক: বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বহু গ্রন্থের লেখক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here