অসহায় মানুষের কিছুই বাকি রইলো না?

0
107

কাজী সাজেদুর রহমান

দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষগুলো যখন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং নিজের স্বাধীন ভোটের অধিকার আদায়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে আর সেই আন্দোলনে পেশিশক্তির নামে গুলির শব্দ বাতাস ফুঁড়ে কোনো না কোনো এক ভাগ্যহীনের বুকে আঘাত করছে। স্বজনহারাদের চোখের জলে বুক ফাটা আর্তনাদ শুনতে থাকা মানুষগুলো তখন দর্শক বনে যায়! বিচার চাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে কাফনের কাপড় আর কবরের জায়গা ঠিক করতেই শরীরে জমে থাকা সব শক্তিই নিঃশেষ হয়ে যায়।
এদিকে অর্থনীতির যাচ্ছেতাই অবস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ এখন তলানিতে। আমদানিনির্ভর একটা দেশের যখন অর্থনৈতিক বাস্তবতা শূন্যের কোঠায়, আর সেই খবর ধামাচাপা দেয়ার কূটকৌশল নিয়ে ব্যস্ত থাকে প্রজাতন্ত্রের কতিপয় দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা। আর তখন উদ্যোক্তা তার প্রয়োজন মতো ঋণ পায় না, আমদানিকারক আমদানিপত্র খুলতে পারে না, কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় না, এমনকি শ্রমিকও তাদের ন্যায্য বেতন থেকে বঞ্চিত হয়। একই সঙ্গে সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে যায়। ঠিক সেই সময় শ্রমিক তার ন্যায্য অধিকার আদায়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। কিন্তু সেখানেও সেই চিরচেনা বুলেটের ধাক্কায় থেমে যায় চিৎকার করে বলতে থাকা অধিকারবঞ্চিত শ্রমিকদের গোঙানির শব্দ। এই মহাযজ্ঞের মধ্যে যাদের জীবন চলে যায় তাদের চিরবিদায় দেয়া হয়! তখন টেলিভিশনের খবরে আর পত্রিকার পাতায় ক্ষণিকের জন্য স্থান পাওয়াটাই হয়ে যায় জীবনের শেষ প্রাপ্তি।

অন্যদিকে যারা নাকি জীবনের সব শক্তি আর মেধা ব্যয় করে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তাদের দীর্ঘদিনের তিলে তিলে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলো। যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছিল হাজার হাজার মানুষের।

কিন্তু ব্যাংকনির্ভর অর্থনীতির একটি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালনাকারী সকল ধরনের প্রতিষ্ঠান যখন কুক্ষিগত হয় গুটিকয়েক ক্ষমতাবানদের হাতে। আর সেই অর্থ চলে যায় দেশের বাউন্ডারি পার হয়ে ভিন দেশে। তখন ওইসব উদ্যোক্তারা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা খুঁজে পায় না। এভাবেই বেকারত্ব আর মুদ্রাস্ফীতির মতো অভিশাপ পুরো জাতির উপর ভর করেছে।

সমাজের কিছু মানুষ আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে ওঠে, যাদেরকে খুঁজে পাওয়া শুধু কঠিন নয় তাদেরকে ধরাও আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষেরা তাদের জীবনের শেষ সম্বলটুকুও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। দু’বেলা দু’মুঠো খাবার পরিবারের জন্য জোগাড় করতে গিয়ে রাতের ঘুমটাও তাদের জীবন থেকে হারাম হয়ে যায়। ভবিষ্যতের কথা ভাবতে গিয়ে চোখ ঝাপসা ও শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে প্রায়। কারণ একটি পরিবার তো শুধু নিজেকে নিয়ে না। সেখানে আছে তার জন্মদাতা পিতা, মাতা, নিজের আদরের সন্তান, নিজের স্ত্রী ও পরিবারের আরও অনেকে। তাদের সব প্রয়োজনের  দায়িত্বভার তো ওই মানুষটাকেই  বহন করতে হয়।
পৃথিবীতে বুদ্ধি আর মেধার বিকল্প আসলে কিছুই না। দুর্নীতিতেও মেধার বড় প্রয়োজন। প্রতিনিয়ত উন্নয়নের যে মহাযাত্রা অথচ খোঁজ নিলে পাওয়া যায় যত বড় মেগাপ্রকল্প তত বড় মেগা দুর্নীতি। সাধারণ মানুষের উপকারের নামে বড় বড় স্বপ্ন বাস্তবায়ন; কিন্তু দিন শেষে হিসাব মিলে না। আর তখন জাতীয় খবর ফিকে হয়ে যায় আর আন্তর্জাতিক খবরের শিরোনাম হয়ে ওঠে আমাদেরই কেউ কেউ নাকি ভিন দেশে শীর্ষ ধনীদের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। সমস্যা হলো- ওই মানুষগুলোর সংখ্যা হাতেগোনা কয়েকজন মানবতা বলতে যে একটি কথা আছে! সেটাও তারা ভুলে গেছে। কারণ তাদেরই সম্পদের পাহাড়ের কারণে আজ তাদের নিজের দেশের মানুষের পকেট খালি। ন্যূনতম চিকিৎসা করার সামর্থ্যটাও শেষ হয়ে গেছে।

মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে চোখের পানি ফেলে চাইতে থাকা এই অসহায় মানুষগুলোর আর কিছুই বাকি থাকে না। কারও কারও ক্ষেত্রে মাথাগোঁজার ঠাঁই পাওয়াটাও দুষ্কর হয়ে ওঠে। এরকম অবস্থায় ভিক্ষুকের সংখ্যা যেমন বাড়তে থাকে, তেমনি গোটা সমাজব্যবস্থা বিনষ্ট হয়ে সামাজিক সংস্কৃতি নিজের ভারসাম্য হারায়। আর যেসব মানব সন্তানরা স্বপ্ন দেখেছিল আমি কিছু একটা হবো। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, এইসব স্বপ্নবাজ মানুষেরাই অনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। অথচ এরকম হওয়ার তো কথা ছিল না।

কিন্তু আমরা সংগ্রামী ও অপরাজেয় জাতি, তাই আশায় বুক বাঁধি। নিজেদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় প্রাণ উৎসর্গ করা সেই সব সাহসী বীর সৈনিকদের উত্তরসূরি আমরা। নিজেদের শেষ সম্বলটুকু নিয়ে মুক্তিকামী জনতার স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার উজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান আমরাই। যারা নাকি মানুষের গণতন্ত্র এবং অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সম্মুখ সারিতে অটল পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বলতে চাই, আপনাদের এই আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না, বৃথা যেতে পারে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here